১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট। সেদিনের ঢাকার আবহাওয়া ছিল খারাপ। এই বৈরি আবহাওয়ায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফকার এফ-২৭ বিমানটি ঢাকা বিমানবন্দরে (বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) অবতরণের সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়। বিমানটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে ঢাকার বিমানবন্দরে অবতরণের কথা ছিল। এ দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা ৪ জন ক্রু ও ৪৫ জন যাত্রী নিহত হন।
সেদিন বিমানের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন কানিজ ফাতেমা রোকসানা। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা পাইলট। প্রিয়জনদের কাছে তিনি ‘লিটল আপা’ নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি বাণিজ্যিক বিমান পরিচালনার সনদ লাভ করেন। কানিজ ফাতেমার জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘তিতলী, যার অর্থ ‘প্রজাপতি’। সে সময়কার সমাজব্যবস্থা ছিল খুবই রক্ষণশীল। সমাজের রক্ষণশীলতার মধ্যে প্রজাপতির মতো উড়ার স্বপ্ন দেখেন ফাতেমা। তবে এ কারণে তাঁকে সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে লড়াই করতে হয়।
কানিজ ফাতেমা ছিলেন ছিলেন রেডিও-টেলিভিশনের সংগীতশিল্পী। এ ছাড়া তিনি ছিলেন জার্মান ভাষার ডিপ্লোমাধারীদের একজন। তাঁর সামনে ছিল জার্মানির মেডিক্যালের স্কলারশিপ। কিন্তু তা ছেড়ে তিনি নীল আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখেন। ফিরিয়ে দেন জার্মানির মেডিক্যালের স্কলারশিপ। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ফ্লাইং ক্লাব খুঁজে সেখানে যোগ দেন। এর ঠিক দুই বছরের মাথায় ১৯৭৮ সালে পেয়ে যান কমার্শিয়াল বিমান চালানোর লাইসেন্স। সঙ্গে আরও পেয়ে যান সহ-প্রশিক্ষকের লাইসেন্স। একি বছরে বাংলাদেশ বিমানের পাইলট নিয়োগের একটি বিজ্ঞাপন দেখে পরীক্ষায় অংশ নেন।
কিন্ত সে সময়ের রক্ষণশীল সমাজ একজন নারীর প্লেন চালানোর বিষয় মেনে নিতে পারেনি। যে কারণে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া স্বত্বেও বাংলাদেশ বিমান তাঁকে নিয়োগ দিতে গড়িমসি করে। পরবর্তীতে তারা বিজ্ঞপ্তি দেয় নিয়োগে কেবলমাত্র পুরুষেরা আবেদন করতে পারবে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের ৩১ মে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ বিমান বনাম মহিলা বৈমানিক’ শিরোনামে একটি চিঠি লিখেন ফাতেমা। সেখানে তিনি সাহসের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন, ‘মহিলা হিসাবে আমি একবিন্দু সুবিধা চাই না বা কোটার সমর্থকও আমি নই, যদি আমি পুরুষের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারি, তবে শুধু মেয়ে হইয়া জন্ম নেওয়ার জন্য আমাকে যেন আমার ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত করা না হয়।’
পরবর্তীতে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এই আলোচনা পৌঁছে যায় সংসদ পর্যন্ত। তাঁর এই লড়াইয়ে সামিল হন জাতীয় সংসদের নারী সদস্যরাও। অবশেষে তাঁদের প্রচেষ্টায় সরকারের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের বিজ্ঞাপন থেকে নারী পুরুষ বৈষম্যের শর্ত সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
এরপর ১৯৭৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম মহিলা পাইলট হিসেবে নিয়োগপত্র পান ফাতেমা। তবে তাঁর নিয়োগের পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি।
Leave a Reply