তৈরি পোশাকশিল্পের দীর্ঘ অস্থিরতা পার হয়ে শ্রমিকরা কাজে ফিরতে শুরু করলেও এখনও ২০টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। স্বেচ্ছায় বন্ধ ঘোষণা ছাড়াও কারখানা এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারায় বেশ কিছু কারখানা বন্ধ আছে। তবু কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে বলে মনে করছেন মালিকপক্ষ।
মালিক ও শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের উভয়ের জন্য একটি বিষয়ই এখন জরুরি—কারখানা খুলে রাখা। তা না হলে আগামী দু-এক মাসের মধ্যে উভয়েই সংকটে পড়বেন বলে শঙ্কা শ্রমিক সংগঠনগুলোর।
পুরো সেপ্টেম্বরেই বিভিন্ন দাবিতে আশুলিয়ায় পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। টানা বিক্ষোভের কারণে তাদের ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে রাজি হয় মালিকপক্ষ। গত ২৪ সেপ্টেম্বর মালিক ও শ্রমিকরা একটি যৌথ ঘোষণা দেন। এতে বলা হয়, দেশের পোশাকশিল্পের সব কারখানার শ্রমিকদের মাসিক হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ছে। তারপরও পুরো স্বস্তি ফেরেনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কারখানাগুলোয় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়। গত এক মাসজুড়ে কারখানাগুলোর নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে আসছেন মালিকপক্ষ। বিষয়টি বিবেচনায় শিল্প এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে।
রবিবার কাঠগড়া এলাকার এআর জিনস প্রডিউসার কারখানায় বহিরাগত লোকজন হামলা চালায়। বেলা ১১টার পর বহিরাগতরা কারখানা পুড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই হামলা চালায় এবং ব্যাপক ভাঙচুর করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিজিএমইএর পরামর্শে কমিউনিটি নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেটি দিয়ে কারখানা খোলা রাখা সম্ভব না বলেও মত দেন ওই এলাকার মালিকরা।
বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) সরেজমিনে আশুলিয়ার কাঠগড়া, জিরাবো, পুকুরপাড়, নরসিংহপুর ও জামগড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি কারখানার সামনেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। যদিও কাঠগড়া এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি বিধায় বেশ কিছু কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে সাত দিন কারখানায় উৎপাদন হয়েছে। বাকি দিনগুলোতে কাজ হয়নি। এ পরিস্থিতিতে মালিকরা বলছেন, তারা ঠিক সময়ে পণ্য জাহাজীকরণে ব্যর্থ হচ্ছেন, হবেন। দিনে কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে, মূল্যছাড়ের শঙ্কাতেও আছেন তারা। এ পরিস্থিতি চললে এর প্রভাব পড়বে শ্রমিকদের ওপরেও।
এদিকে জিরাবো এলাকার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কাজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু কারখানার ভেতরে কিছু বহিরাগত নানা হাঙ্গামা তৈরি করতে পারে, এমন শঙ্কায় থাকছেন। এরা কারা, জানতে চাইলে তারা বলেন, যাদের ৫ আগস্টের আগে চাকরি গেছে, তারা ফিরতে চান, আবার শ্রমিকদের মধ্যেও চাকরি জোগাড় করে দিয়ে কমিশন খাওয়া লোক আছে, তারা অস্থিরতা তৈরি করছে।
ছবি: বাংলা ট্রিবিউন
ছবি: বাংলা ট্রিবিউন
কাঠগোড়ার বন্ধ কারখানার এক শ্রমিক বলেন, আমরা চাই কারখানা খোলা থাকুক। আমাদের চাকরির নিশ্চয়তা না থাকলে কোথায় যাবো? প্রকৃত শ্রমিক কখনোই কারখানার ক্ষতি চাইবে না। আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এখনও অন্য জায়গা থেকে লোক এসে নানা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে। বেতন বাড়ানোর ঘোষণা হলেও আসলে বাড়বে না বলে শ্রমিকদের উত্তেজিত করছে। আন্দোলন করা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা হবে বলেও গুজব আছে। কারখানা খোলা থাকলে শ্রমিকদের ভুল বোঝাতে পারবে না কেউ। আমরা চাই আমাদের চাকরির নিশ্চয়তা।
মালিকদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়, মধ্যমসারির ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তাদের বেশির ভাগই বিরক্ত হয়ে আছেন নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে। তাদের প্রশ্ন, যে লস হচ্ছে প্রতিদিন, তা কত দিনে উঠবে? ইন্ডাস্ট্রিতে সবার অবস্থা এক না। সবাই এই পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারবে না।
তারা বলছেন, লাভ-লসের হিসাব আছে, কিন্তু প্রধান কথা হলো, কারখানা খোলা রাখতে তো হবে। কেউ খুশিতে বন্ধ করে বসে থাকে না। কয়দিন বুঝিয়ে রাখা হবে ক্রেতাদের? তার কাছে বিকল্প আছে এবং সে পণ্য না পেলে সেখানে চলে যেতে চাইবেই।
সব শ্রমিকই চান কারখানা খোলা থাকুক। এটা তাদের রুটি-রুজির বিষয় উল্লেখ করে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মালিকদের বড় অংশ বিগত সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। যে ১৮ দফা নিয়ে আমরা চুক্তি করলাম, সেসব মালিক এই দাবিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নে জটিলতা আছে। শ্রমিকদের মধ্যে সন্দেহ আছে।
তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তা ইস্যুটা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হলো, সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া জরুরি। কেননা, এই শ্রমিকরাও কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের অংশ।
কারখানাগুলোকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে হবে। তা না হলে কারখানাগুলো রুগ্ণ হয়ে যাবে। সেগুলোকে টিকিয়ে রাখা যাবে না উল্লেখ করে বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, অতীতে নিরাপদ কর্মক্ষেত্রের দাবি ছিল শ্রমিকদের জন্য। এখন নিরাপদ কর্মস্থল শুধু শ্রমিক নয়, এটা মালিক ও কর্মচারীদের জন্যও প্রযোজ্য।
নিরাপত্তাহীনতায় শ্রমিক ও কর্মচারীরা কাজ করতে চান না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দাবি, আমাদের কারখানা খোলা রাখার পরিবেশ তৈরি করে দেন। ৫ আগস্টের পর যখন পুলিশ, শিল্প পুলিশ ছিল না, তখন নিজেরা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু সেটা তো চিরস্থায়ী সমাধান নয়, সেটা সঠিক পথও নয়। আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, বিশৃঙ্খলা করে গুটি কয়েক শ্রমিক, তারা বহিরাগত। বাকি প্রকৃত শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে হবে। কারখানার ভেতর শ্রমিক ছাড়া কর্মকর্তা থাকে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
Leave a Reply