সরকারের পটপরিবর্তনের পর বাতিল হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০-এর কার্যক্রম। এর ফলে কাজ শুরু না হওয়া মেগা প্রকল্পের সঙ্গে বাতিল হচ্ছে অনেক ছোট প্রকল্পও। দেশ এরই মধ্যে জ্বালানি নিয়ে সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ফলে এই আইনের আওতার সব প্রকল্প বাতিল করা উচিত হবে কিনা, পরিস্থিতি বিবেচনায় কোনোটা রাখা সম্ভব কিনা–এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে সামনের দিনগুলোতে জ্বালানি সংকট বাড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১০ সালে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বিধান বৃদ্ধি (বিশেষ আইন) আইন’ প্রণয়ন করে সরকার। তখন বলা হয়েছিল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে এই আইন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার এ খাতের বেশিরভাগ উন্নয়ন প্রকল্প এই আইনেই বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়। প্রণয়নের পর থেকে ১৬ বছরের জন্য এই আইন কার্যকর থাকবে বলেও উল্লেখ করা হয়। সে অনুযায়ী আইনের মেয়াদকাল ২০২৬ সাল পর্যন্ত ছিল।গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। গত ১৮ আগস্ট নিজের প্রথম কর্মদিবসে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির ২০১০ সালের বিশেষ আইনটির কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সব মূল্যবৃদ্ধির কার্যক্রম স্থগিত করেন তিনি।সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রায় সব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনে। এই আইনে যেসব প্রকল্পকে বিগত সরকার কার্যাদেশ দিয়েছিল এবং যাদের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি করেছিল সেগুলো রেখে বাকি সব প্রকল্প বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের অন্তত ৪৩টি প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, বিশেষ আইন বাতিল হওয়ায় ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিট, সামিট এবং এক্সিলারেট এনার্জির দুটি ভাসমান টার্মিনাল এবং ভারত থেকে গ্যাস আমদানির জন্য এইচ এনার্জির চুক্তির প্রক্রিয়াও বাতিল করা হচ্ছে। এছাড়া রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রমের সঙ্গে করা চুক্তিটি বাতিল করা হচ্ছে। বিশেষ আইনে ভোলায় তেল গ্যাস কূপ খনন করার উদ্যোগ নিচ্ছিল গ্যাজপ্রম। এছাড়া ভোলা থেকে একক কোম্পানিকে দিয়ে গ্যাস আনার সিদ্ধান্তও বাতিল করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এসব প্রকল্পের বিষয়ে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বিদ্যুৎ খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক বৈঠকে বলেছেন, সরকার প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া আর কাজ দেবে না। অর্থাৎ এখন কাউকে কাজ পেতে হলে অবশ্যই তাদের প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অংশ নিতে হবে। তবে এসব প্রকল্পের ভাগ্যে কী রয়েছে তা এখনও কেউ নিশ্চিত নয়। কারণ সরকার এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি।এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, বাতিলের বিষয়টি আমি সমর্থন করি। চুক্তিগুলো রিভিউ করে বেশি অর্থ ব্যয় হয়ে থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। পাশাপাশি আগামীতে যাতে জ্বালানির কোনও সংকট না হয় সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ধীরে ধীরে নতুন প্রকল্পও হাতে নেওয়া যেতে পারে।
বিগত সরকার আগামী দুই থেকে তিন বছর পর দেশের জ্বালানি খাতে গ্যাসের সরবরাহ বিবেচনা করে সামিট এবং এক্সিলারেট এনার্জির এলএনজি টার্মিনাল দুটি নির্মাণের চিন্তা করেছিল বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মাতারবাড়ির মহেশখালীতে যেখানে সামিট ও এক্সিলারেট এনার্জির দুটি টার্মিনাল রয়েছে সেখানে আরও একটি টার্মিনাল নির্মাণ এবং পায়রা বন্দর এলাকায় আরও একটি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। দেশীয় জ্বালানি, বিশেষ করে গ্যাসের স্বল্পতার কারণে এবং দ্রুত দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না––এমন বিবেচনায় টার্মিনাল দুটি নির্মাণ করা হচ্ছিল।উল্লেখ্য, আপাতত ভাসমান টার্মিনাল ছাড়া গ্যাস আমদানির কোনও উপায় নেই। স্থায়ীভাবে টার্মিনাল নির্মাণ করা সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ বিষয়।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, এসব এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়ে দরপত্র আহ্বান বা আদৌ আর এগুলো নির্মাণ করা হবে কিনা সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত এখনও আসেনি। ভবিষ্যতে তাহলে গ্যাস সংকটের সমাধান কীভাবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়। এখানে পেট্রোবাংলার কিছু করার নেই।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণ করে বিগত সরকার জ্বালানি আমদানিতে ডলার সাশ্রয়ের চিন্তা করছিল। কিন্তু এসব প্রকল্পও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সরকার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নিলে বিদ্যুৎ খাতেরও ব্যয় কমানো সম্ভব হবে না।জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দ্রুত সরবরাহ আইন বাতিল হোক এটা আমরা সবাই চেয়েছিলাম। কিন্তু এখনও আমরা জ্বালানি সংকটের মধ্যেই আছি। হঠাৎ করে এতগুলো প্রকল্প বাতিল না করে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা এমনিতেই অনেক পিছিয়ে আছি। এসব প্রকল্প দরপত্রের মাধ্যমে এমনিতেই বাস্তবায়ন সম্ভব না। সুতরাং এসব প্রকল্পের দামের বিষয়গুলো নতুন করে আলোচনা করে দ্রুত বাস্তবায়নে নেওয়া গেলে ভালো হয়।
তিনি আরও বলেন, এমনিতে গ্যাস সংকট আছে। এই মুহূর্তে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প বাতিল না করে একইভাবে পর্যালোচনা করা যায় কিনা, অথবা সরকার নিজেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে কিনা তা ভাবা যেতে পারে। এসব প্রকল্প ২০২৬ সালের দিকে আসার কথা। এগুলো এখন বাতিল করে নতুন করে দরপত্র করে বাস্তবায়ন করতে গেলে আমরা কমপক্ষে এক বছর পিছিয়ে যাবো। পাশাপাশি এক বছরের ভোগান্তির জন্যও আমাদের তৈরি হতে হবে। দ্রুত এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করা দরকার, তিনি অভিমত দেন।
Leave a Reply