নারীর প্রতি সব বৈষম্যমূলক আইন দূর হবে, এই সমাজ হবে সমতার। নারীর প্রতি নিপীড়ন করে কেউ পার পেয়ে যাবে না। এমন একটা সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে চতুর্থবারের মতো আজ মধ্যরাতে শেকল ভাঙার পদযাত্রা। এই পদযাত্রা কেবল নারীদের জন্য। আয়োজকরা বলছেন, পুরুষ সহযোদ্ধা, নারীবাদী পুরুষ বন্ধুরা সংহতি জানাতে পারবেন, কিন্তু এই পদযাত্রা কেবল নারীদের। আর নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, নারীর জন্য বেঁধে দেওয়া রাস্তায় আর নয়।
২০২০ সাল থেকে এই পদযাত্রার শুরু। সে বছর এর উদ্যোগ নেন কিছু শিক্ষার্থী। শাহবাগ থেকে শুরু করে কলাবাগান হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গিয়ে অবস্থান নেন তারা। মধ্যরাতে গান, ঢাক, ঢোলের শব্দে তারা জানান দেন– পুরুষের ক্ষমতা ভেঙে হোক সমতা। তারা দাবি তোলেন– স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার দিতে হবে। মধ্যরাতে রাজধানীর পথে পথে মশাল হাতে পদযাত্রায় নেমে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে চান তারা।
এই পদযাত্রার আয়োজকদের একজন তাপসী দে প্রাপ্তি বলেন, আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২০২০ সালে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই যাত্রা শুরু করেছিলাম। এবার চতুর্থবারের মতো এই যাত্রা হচ্ছে। নারীর প্রতি নিপীড়ন, রাষ্ট্রের পিতৃতান্ত্রিক অবস্থানের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ। যে কেউ এই পদযাত্রায় অংশ নিতে পারেন, কিন্তু তাকে নারী হতে হবে।
কোনও নারীবাদী পুরুষেরা অংশ নিতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের বন্ধু নারীবাদী পুরুষ সহযোদ্ধারা সংহতি জানাতে পারবেন। কিন্তু এটা পদযাত্রাটা কেবল নারীদের।
নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা শিরিন হক প্রতিবারই অংশ নেন এই পদযাত্রায়। এ ধরনের পদযাত্রার গুরুত্ব উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে যারা যুক্ত হয়েছে উদ্দীপ্ত হচ্ছে। সেটা ইতিবাচক। এরকম একটা প্রতিবাদ প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করতে পারাটা, রাতের রাস্তায় নারীদের বেরিয়ে আসা এবং নিজের অবস্থান জানান দেওয়াটা যে উদ্দীপনা তৈরি করে, সেটা নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করতে সহায়তা করবে।
এই পদযাত্রায় নিজের দায়িত্বের জায়গা থেকে সবসময় হাজির হয়েছেন উল্লেখ করে অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন বলেন, কিছু শিক্ষার্থী গত চার বছর ধরে এই উদ্যোগ নিয়ে আসছে। আমি তাদের সঙ্গে সংহতি জানাতে সেখানে যাই। মূল কথা হলো, অন্যায়-নিপীড়ন বন্ধ করতে হলে সরব থাকতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা মনে করছি স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু স্বৈরাচারের পতন হলেই রাতারাতি সব পরিবর্তন হয়ে যাবে না। নারীদের ব্যাপারে তো আরও না। নারীর প্রতি যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, হত্যা চলছে। তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। আইনগতভাবে কাঠামোবদ্ধভাবে তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং সেটা আমার সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিকীকরণও ঘটছে। আমরা সাম্প্রতিক আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সেই কারণেই বারবার প্রশ্ন করছি নারী সমন্বয়করা কেন সামনে নেই। তাদের দেখা যায় না কেন। আমাদের সমাজে মেয়েদের অবদানকে গ্রহণযোগ্য হতে দেওয়া হয় না। এসবের পরিবর্তন দরকার। ভারতের মৌমিতার সঙ্গে যে নির্মমতা ঘটেছে সেটা কেবল ভারত বলে ঘটেছে এমন তো নয়। আমরা সব ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতিরোধে পদযাত্রায় অংশ নেবো।
২০২১ সালের ১২ নভেম্বর মধ্য রাতে সাক্ষ্যপ্রমাণ আইন-১৮৭২ বাতিলসহ নানা দাবিতে শাহবাগ থেকে নারীদের পদযাত্রা
প্রথম পদযাত্রায় ১২ দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনে ও সামাজিকভাবে ধর্ষণের সংজ্ঞা সংস্কার করা; পাহাড় ও সমতলের সব নারীর ওপর সব ধরনের যৌন এবং সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করা; জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লৈঙ্গিক পরিচয় নির্বিশেষে যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ বন্ধ করা; গ্রামীণ সালিশ/পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা; প্রাথমিক পর্যায় থেকেই পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা (গুড টাচ ব্যাড টাচের শিক্ষা, সম্মতি বা কনসেন্টের গুরুত্ব, প্রাইভেট পার্টস সম্পর্কে জানানো) যোগ করা; ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এর ১৫৫(৪) ধারা বিলোপ এবং মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য-প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করা; হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতনবিরোধী সেল পূর্ণ বাস্তবায়ন করা; সিডিও সনদে স্বাক্ষর করা ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইন ও প্রথা বিলোপ করা প্রভৃতি।
Leave a Reply