জন এফ ড্যানিলোয়িচ
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া এবং তাদের রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে খুব সংক্ষেপে কী বার্তা দেওয়া যায় তার কিছু উদাহরণ আমি অতীতে উত্থাপন করেছি। একই চিন্তা থেকে মনে হচ্ছিলো, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার মন্ত্রিসভা নতুন দায়িত্ব নেওয়ার সময় যদি কয়েক মিনিট কথা বলার সুযোগ পেতাম তাহলে কী পরামর্শ দিতাম। আমার মন বলছে সেরা যে কাজটা আমি করতে পারতাম তা হলো- ২০০৭-০৮ মেয়াদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মারাত্মক কিছু ভুলের বিষয় তাদের সামনে তুলে ধরতাম। যেসব ভুলের কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কারের প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্থ হয়েছিলো। একইসময়ে রাজনৈতিক সংস্কার বাধাগ্রস্থ হবার সেই ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের ভুল স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক অংশীদাররা। যদিও প্রতিটি বিষয় দীর্ঘ আলোচনা দাবি করে তবুও সংক্ষিপ্ত বার্তার উদ্দেশ্য হলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া। পুরো বিষয় খোলাসা করার স্বার্থে বলছি, আমি এই আশায় উপদেশ দিচ্ছি যাতে প্রফেসর ইউনূস এবং তার সরকার বাংলাদেশকে অধিকতর প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যতের পথে নিয়ে যাবার যে ঐতিহাসিক সুযোগ সামনে এসেছে তারা যেন সেটা কাজে লাগাতে পারেন।
আমার প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হলো, অন্তর্বর্তী এই সরকারকে সেনাবাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যদি এটি করা সম্ভব না হয় তাহলে পেছন থেকে সেনাবাহিনীকে শাসন করার সুযোগ না দিয়ে তাদের পদত্যাগ করাটাই উত্তম। ২০০৭-০৮ মেয়াদে বাংলাদেশ কিংবা বিদেশে কেউই এটা ধারণা করতে পারেনি যে প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমেদ এবং তার উপদেষ্টারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছেন। কিছু উপদেষ্টা সেই প্রশাসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন সেনাপ্রধান এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কিছু লোক (এরা প্রায় সময়ই সেনাপ্রধানকে বিভ্রান্তিমূলক উপদেশ দিতেন)। আমি এ কথা বলতে চাচ্ছিনা যে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকার সুযোগ নেই। বরং, সেনাবাহিনী অবশ্যই বেসামরিক সরকারের অধীনে থাকবে। তাদেরকে ঊর্ধ্বতন বেসামরিক কর্তৃপক্ষ যখন ডাকবে তখন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
২০০৭-০৮ মেয়াদে যে শংকর সরকার গঠিত হয়েছিলো, যাদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এবং রাজনৈতিক দল সংস্কারসহ বেশ কিছু বড় বড় সংস্কারের দায়িত্বের ভার দেওয়া হয়েছিলো সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার পদবীর কিছু গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের হাতে। এর ফলে কুখ্যাত “মাইনাস টু” ফর্মূলা তৈরি হয়। এই ফর্মূলা ব্যার্থ হয়েছিলো, এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে যারা সংস্কারের বেশী আগ্রহী ছিলেন তাদের দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো, তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। কিছু ব্রিগেডিয়ার রাজনীতিবিদদের একটি অংশের সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু শেষে দেখা গেলো চালাক সেই রাজনীতিবিদরা সেই ব্রিগেডিয়ারদের আর পাত্তাই দেননি। সাধারণভাবে বলতে গেলে, ২০০৭-০৮ মেয়াদে যে শংকর সরকার গঠন করা হয়েছিলো সেই সরকারের নিজেদের অগ্রাধিকারের তালিকা নিয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণাই ছিলোনা। আর সে কারণেই সহজে তাদের পথ হারিয়েছিলো। সেই সরকারের মেয়াদের অধিকাংশ সময়টাতে বেসামরিক পর্যায়ের উপদেষ্টা যারা ছিলেন তারা ছিলেন সংখ্যা এবং দক্ষতায় পিছিয়ে। যার কারণে সেনাবাহিনীর প্রভাব বিস্তারের পথ খুলে গিয়েছিলো। সরকারের বেসামরিক উপদেষ্টাদের যেরকম সহায়তা করার দরকার ছিলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা করতে ব্যর্থ হয়েছিলো।
২০০৭-০৮ মেয়াদের সরকার বারবার জোর দিয়ে বলছিলো যে তারা “রাজনৈতিক” সরকার না। এ মন্তব্যে বুঝা যায় যে সরকার আসলে কীভাবে কাজ করে তার মৌলিক ধারণাতেই তাদের গলদ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার দলীয় হয়না। তবে আসল কথা হলো বাংলাদেশের যেকোনো সরকারই রাজনৈতিক হয়ে থাকে। এদিকে, রাজনীতিতে কম ব্যস্ত থাকা রাজনীতিবিদরা যেভাবে জনগণ এবং সরকারের সঙ্গে সেতু বন্ধন তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে ঠিক সেভাবে নিজেদের ভূমিকা পালনে কখনো সফল হতে পারেনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ঐতিহ্যগতভাবে রাজনীতিবিদরা যে ভূমিকা পালন করে এসেছেন সেই একই ভূমিকার জন্য আমলা এবং সেনাবাহিনীর জুনিয়র কর্মকর্তাদের ওপর সেই ভরসা করা যায়না।আন্তর্জাতিক যেকোনো বিষয়ে অন্তর্মুখী বৈশিষ্ট্যের প্রধান উপদেষ্টা বিদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ততটা আগ্রহী ছিলেননা। নিজ দেশের নাগরিকদের সঙ্গেও তিনি একই আচরণ করেছেন। যদিও ২০০৭-০৮ মেয়াদের সরকারে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তবুও মাঝে মাঝে প্রটোকলগত উদ্বেগের কারণে শীর্ষ পর্যায় থেকে কূটনৈতিক তৎপরতার ঘাটতি ছিলো। আর এ কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সহযোগিতার বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেনি। এর বিপরীতে, সেনাপ্রধানকে সহজে পাওয়া যেতো, তিনি নিজেকে এমনভাবে জাহির করতেন যে, বুঝাতেন তিনিই আসল ব্যক্তি।
এলিভেটর সম্ভবত এখন তার গন্তব্যে পৌঁছানোর কাছাকাছি, আমি সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির উপর জোর দিয়ে শেষ করব-যাতে এটি শ্রোতার মনে গেঁথে থাকে। ২০০৭-০৮ সালের সরকার নিজেদের ইচ্ছেমতো তাদের মেয়াদ শেষ হবার সময়সীমা নির্ধারণ করে একটি গুরুতর ভুল করেছিল। সুনির্দিষ্ট সময় এবং শর্তের ওপর জোর না দিয়ে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উৎসাহে নিজেদের মেয়াদ শেষের তারিখ ঘোষণা করে বসে। এ ঘোষণার পর রাজনীতির সুবিধাবাধীরা তাদের আগের অবস্থানেই ফিরে যায়। তারা এটা বুঝে নেয় যে ক্ষমতা সরকারের হাত থেকে সংস্কারবিহীন রাজনৈতিক শ্রেণীর হাতে চলে এসেছে। তারা এটা বুঝে নেয় যে, পরিবর্তনে যে দাবি তার পরিবর্তে শুধু ‘লিপ সার্ভিস’ দিলেই চলবে।
এখন এলিভেটরের দরজা খুলে যাবে। নতুন সরকারকে আমার শেষ উপদেশ হলো- অপ্রত্যাশিত কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকা। যেমন শেখ হাসিনা কখনোই ধারণা করতে পারেননি যে একটি স্ফুলিঙ্গ তার শাসনের অবসান ঘটাবে ঠিক তেমনি সব সরকারকে অবশ্যই অনিশ্চয়তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। দুর্বল নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলো ২০০৭-০৮ সালের সরকার। এসময় বিশ্বে খাদ্য এবং জ্বালানির দাম বেড়ে গিয়েছিলো। খেলার মাঠে একটি ছাতাকে কেন্দ্র করে সংঘাত সূচনা করেছিলো ছাত্র বিক্ষোভের। আজকের বিশ্বে ছোটো-খাটো কিছু ঘটনা ঘটছে যা ইঙ্গিত দেয় যে আসন্ন মাস এবং বছরগুলি সাম্প্রতিক অতীতের চেয়ে স্থিতিশীল হবেনা।
[ওয়াশিংটনভিত্তিক ম্যাগাজিন সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভসে এডিটর এ্যাট লার্জ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেপুটি মিশন প্রধান জন এফ ড্যানিলোয়িচের লেখা উপ-সম্পাদকীয়টি জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন সিনিয়র সহ-সম্পাদক গোলাম ইউসুফ]
Leave a Reply