বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের পরিচালিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দীর্ঘ ৫৩ বছরেও আদায় হয়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা করেছে। এই দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জরুরি’। জাতিসংঘে গণহত্যার ঘটনায় বাংলাদেশের জন্য যে সময় বরাদ্দ আছে, সে সময়ে বিষয়টি বিশ্ববাসীকে অবহিত করা হবে। এতে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথ প্রশস্ত হবে। কেউ যেন মিথ্যাচার ও অসত্য তথ্য দিয়ে দিয়ে এ ঘটনাকে (গণহত্যা) হালাল না করতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। পৃথিবীতে এতো স্বল্প সময়ে এতো মানুষ হত্যার রেকর্ড নেই। এরপর দীর্ঘ ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধীরা বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে ও সারাদেশে ব্যাপক লুটতরাজ চালিয়েছে। দুই লাখ মা-বোনের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনতা হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে স্বপরিবারে হত্যার পর সেই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্বাধীনতা বিরোধীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচার শুরু করেছে। রাজাকার-আলবদরদের তালিকা তৈরি জন্য সংসদে আইন পাস হয়েছে। আশাকরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলগুলোর নিবন্ধন নির্বাচন কমিশন বাতিল করবে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৩ বছরে পদার্পন করলেও মুক্তিযুদ্ধকালে সংগঠিত নৃশংস গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের স্বীকৃতি আজো মেলেনি। সেই স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংগঠন,স্বাধীনতা ফাউন্ডেশন, আমরা একাত্তর, প্রজন্ম ৭১ ও নেদারল্যান্ডসের প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন বাজুগ কাজ করে যাচ্ছে। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে গণহত্যার স্বীকৃতি দাবির লড়াইয়ে নেমেছি। গণহত্যার স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন। এখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আছে, সেজন্য অন্যান্য দেশের গণহত্যার স্বীকৃতি পায়নি। কিন্তু আমাদের সুযোগ রয়েছে, যেহেতু জাতিসংঘ ভবনে এটি অনুষ্ঠিত হবে।
চলমান কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে একটি মোমেন্টাম তৈরি হচ্ছে। আমরা যদি এটি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি ৯ ডিসেম্বরের আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসে যেন বাংলাদেশের প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়।
জাতিসংঘের এজেন্ডায় ১৯৭১ সালের গণহত্যার স্বীকৃতি
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এজেন্ডায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার চিত্র এবং গল্পগুলো নিয়ে একটি প্রদর্শণী অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৫ মার্চ “১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার নিহতদের স্মরণে” শীর্ষক এই তিনদিনব্যাপী প্রদর্শনীর শুরু হয়।
১৯৭১ সালে দখলদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের উপর যে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছিল-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের প্রচেষ্টায় এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।এই গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করতে আরো বেশি প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। ১৯৭১ সালের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং অন্যান্য নৃশংস অপরাধ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে।এ বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসের সম্মতিও মিলেছে, যা বিবৃতি আকারে প্রকাশ করেছে বিশ্বসংস্থাটি। এখন ’৭১-এ বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের গণহত্যার আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘের স্বীকৃতির বিষয়টি সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
এরফলে বাংলাদেশে ’৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত ভয়াবহ নৃশংস গণহত্যা তথা জেনোসাইডের বিশ্ব স্বীকৃতির পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো।এর আগে গত ২৪ এপ্রিল গণহত্যা বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল জেনোসাইড স্কলার্স অ্যাসোসিয়েশন (আইএজিএস) সর্বসম্মতিক্রমে পাস করে প্রস্তাবটি। এতে ’৭১-এর বাংলাদেশে সংঘটিত পাকি হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ’ ঘোষণা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বিশ্বের জেনোসাইড স্কলার্সদের পাশাপাশি অনেক বিজ্ঞ আইনজীবীও এই সংস্থার সদস্য। জেনোসাইড হিসেবে ঘোষণার যুক্তি হিসেবে ’৭১-এর ৯ মাসে সংঘটিত ভয়াবহ ও নৃশংস সব ঘটনার প্রমাণাদি ও বিবলিওগ্রাফি তুলে ধরা হয়। এই স্বীকৃতির বিষয়টি আইএজিএসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ’৭১-এর গণহত্যার বিশ্ব স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি আরও সহজ ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেসেও একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে ইতোমধ্যে, যা পালন করবে ইতিবাচক ভূমিকা।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পরিম-লে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি জাতির ওপর ঘৃণ্য ও বর্বরোচিত হামলা, মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ এবং তিন লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিষয়টিকে কেন্দ্র করে গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি বাংলাদেশ জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সম্প্রতি সুইজ্যারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের ২৫নং কক্ষে আলোচনাসভা, প্রতিবাদ, মানববন্ধন সর্বোপরি বাংলাদেশ জেনোসাইড বিষয়ক ভিডিও প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের গণহত্যা জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতির দাবিতে ৯ দিনব্যাপী কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে দেশেও পালন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠান ও কর্মসূচি। এখন এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার, পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে আরও জোরালো ও বলিষ্ঠ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
গঠন করতে হবে বিশ্বজনমত। যে বিষয়ে সহযোগিতা করতে পারে ভারত, রাশিয়াসহ বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে শুধু ২৫ মার্চ নয়, পুরো মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের গণহত্যার স্বীকৃতি চায় বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে আত্মসমর্পণকৃত ১৯৫ পাকিস্তানি সেনার বিচারের পথও উন্মুক্ত হবে। উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক মাতৃভাষা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমরা পেয়েছি ১৯৯৮ সালে। অতঃপর ’৭১-এর গণহত্যার বিশ্ব স্বীকৃতিও যে অচিরেই পাওয়া যাবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ………….চলবে
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা.এম আমজাদ হোসেন
সমাজসেবা ও জনসেবায় স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত।
Leave a Reply