জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এই বাধ্যতামূলক অবসর প্রশাসনে অস্থিরতার সৃষ্টি করবে। যেটা সরকারের জন্যও ভালো নয়, প্রশাসনের জন্য ভালো নয়। সবার মধ্যে এখন কাজ করতে গেলে এক ধরনের সংশয় কাজ করবে। এতে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ বাধাগ্রস্থ হবে। আর সংবাদ মাধ্যমে সচিব বা তিনজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ লেখা হয়েছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে তো তাদের অবসরে না পাঠিয়ে বিভাগীয় বা ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া যেত। বাধ্যতামূলক অবসর তো কোন শাস্তি নয়। তিনি তো সকল সুযোগ সুবিধা পাবেন।”
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিবকে অবসরে পাঠানোতে প্রশাসনে কোন প্রভাব পড়বে না। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সরকার এই প্রক্রিয়ায় যে কাউকে চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলে অবসরে পাঠাতে পারে। এতে প্রশাসনে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার কিছু নেই।”
মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় এক বছর আগে গত রোববার তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মো. মকবুল হোসেনকে চাকরি থেকে অবসরে পাঠায় সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টের আদেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী জনস্বার্থে সরকারি চাকরি থেকে অবসর দেয়া হলো।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, “বিএনপি শাসনামলে এমন বেশ কয়েকজন সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। পরে সেই কর্মকর্তারা আদালতে গেলে আদালত তাদের পূর্ণবহালের আদেশ দেন। কারণ যে আইনের বলে জনস্বার্থে তাদের অবসরে পাঠানো হয়েছে আদালতে সরকার সেই জনস্বার্থ প্রমান করতে পারেনি। এই ধারাটি মূলত করা হয়েছিল সরকারি কর্মচারীদের স্বার্থে। যাতে তারা ২৫ বছর পর চাইলে নিজেই অবসরে যেতে পারেন।”
তবে সাবেক জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এই ধরনের অবসরের মাধ্যমে আইনের তো কোন ব্যত্যয় হচ্ছে না। আইন সরকারকে সেই সুযোগ দিয়েছে। এতে প্রশাসনে অস্থিরতারও কিছু নেই।” নির্বাচনের আগে এই অবসর কি কোন বার্তা বহন করে? জবাবে জনাব হারুন বলেন, “নির্বাচনের সঙ্গে প্রশাসনের শৃঙ্খলার কোন সম্পর্ক নেই। এখন নির্বাচনের নামে সরকার তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। দৈনন্দিন কার্যক্রম তো স্বাভাবিক গতিতেই চলবে। সেখানে যদি কেউ অপরাধ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নিতেই হবে। তা না হলে শৃঙ্খলা থাকবে না।”
বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানো দৈনিক ইত্তেফাক তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, “বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হচ্ছে আরো পাঁচ সচিবকে। সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে। শুধু সচিব নন, কয়েক জন অতিরিক্ত সচিবও আছেন এই ষড়যন্ত্রে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ১২। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এই ১২ জনের দৈনন্দিন চলাফেরা, মোবাইল ফোনে যোগাযোগসহ দেশে-বিদেশে তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে বিস্তারিত রিপোর্ট দিয়েছে। বর্তমান সচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত কয়েক জন সচিবও এ কাজে যুক্ত আছেন। এদের কারো কারো বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হতে পারে।”
এ বিষয়ে জনাব ফিরোজ মিয়া বলেন, “সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ যদি কারও বিরুদ্ধে থাকে তাহলে তো ফৌজদারি মামলা হতে পারে। সরকারের হাতে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকলে বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি এই মামলায় তো কোন বাধা নেই। তাহলে বাধ্যতামূলক অবসর কেন?”
আর তিনজন এসপিকে অবসরে পাঠানোর পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে সিনিয়র সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, “সরকার বিনা কারণে কাউকে অবসরে পাঠায় না। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ছিল। আর চাকরির বয়স ২৫ বছর হয়ে গেলে সরকার অবসরে পাঠাতে পারে।”
এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আরেকটু খোলসা করেই বলেছেন, “তারা কোনো কাজ করেন না। হাজিরা দিয়ে চলে যান। তাদের পেছনে ৮-১০ জন কনস্টেবল থাকেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা ফেসবুকে ভুয়া সংবাদ আদান-প্রদান করেন। পুলিশ সদর দপ্তর আমাদের কাছে তাদের অবসরে পাঠানোর প্রস্তাব পাঠালে আমরা তা বাস্তবায়ন করেছি।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেখানে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের কথা বলছেন সেখানে প্রশাসনিক বা ফৌজদারি ব্যবস্থা না নিয়ে কেন অবসরে পাঠানো হচ্ছে? জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বাধ্যতামূলক অবসরও এক ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ফলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছে সেটা বলাই যায়। আর ফৌজদারি ব্যবস্থা সেটা যে তাৎক্ষণিক নিতে হবে এমন নয়। পরেও সরকার সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারে। আমরা অপেক্ষা করি, দেখা যাক কী হয়?”
Leave a Reply