দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর টানা অবরোধ-হরতাল ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো একেবারে পর্যটন শূন্য। বিদেশি পর্যটকরাও করেছেন ভ্রমণ বাতিল। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় আগামী জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সারাদেশের হোটেল, মোটেল, রিসোর্টগুলোতে গড়ে ৮০% পর্যন্ত অগ্রিম বুকিং বাতিল হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন পর্যটন খাতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীসহ এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক লাখ মানুষ। দেশের পর্যটন শিল্পকে লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ রাখতে হবে।
কুয়াকাটায় নেই প্রাণচাঞ্চল্য
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নিবাসী মোহাম্মেদ শাওন প্রতিবছরই পর্যটন মৌসুমে পরিবার নিয়ে ঢাকার বাইরে যান। গত শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) কুয়াকাটা পৌঁছে শাওন চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান, গত বছর হোটেলে রুম পেতে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছিল। অনেক কষ্টে পরিচিতজনদের মাধ্যমে রুম পেয়েছিলাম। এ বছর পুরো হোটেল প্রায় বলতে খালি। কুয়াকাটাও প্রায় জনমানব শূন্য। সৈকত জুড়ে অন্যবারের তুলনায় পর্যটক খুবই কম। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যাবার গাড়িতে পর্যন্ত মানুষজন ছিল না। অর্ধেকের বেশি খালি গাড়িতে আমরা কুয়াকাটা পৌঁছাই।
কুয়াকাটা সাগর কন্যা রিসোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. হারুন শিকদার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, গতবছর পর্যটকদের ভিড়ে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে।এই বছর রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য আমাদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রুম খালি পড়ে আছে। এই সময়ে আমাদের পর্যাপ্ত ছাড় দিয়েও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারছি না।
পর্যটক দর্শনার্থী না থাকায় হতাশ ব্যবসায়ীরা। অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। সৈকতজুড়ে সুনসান নীরবতা। পর্যটক না থাকায় সৈকতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে রেখেছেন।
সৈকতের স্পিড বোটের মালিক সমিতির সভাপতি মো. বেল্লাল খলিফা জানান, সৈকতে ২২ টি স্পিডবোটের চালক সবাই বেতনভুক্ত। তাদের একজনের বেতন ১২-১৫ হাজার টাকা। সকলেই পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল। পর্যটক না থাকায় নানামুখী সংকটের মধ্যে দিন পার করছেন তারা। কিভাবে সংসার চলবে এনিয়ে সবাই চিন্তিত।
পর্যটক শূন্য বান্দরবান
পাহাড় ঘেরা সৌন্দর্যের অপরূপ লিলাভূমি বাংলার দার্জিলিং খ্যাত মেঘের রাজ্য বান্দরবানের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে নেই পর্যটক। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই বান্দরবান পর্যটক শূন্য। এখানে গড়ে পর্যটক কমেছে ৮০ শতাংশ। অথচ প্রতিবছর শীত মৌসুমের শুরুতে জমজমাট থাকে এই পার্বত্য জেলার মেঘলা, নীলাচল, নীলগিরিসহ জেলার দর্শনীয় সব স্পট।
পর্যটন ঘিরে এখানে গড়ে ওঠা প্রায় ৩০০ হোটেল-মোটেল, রিসোর্টে অগ্রিম বুকিং নেই। তেমনি পর্যটক বহনকারী শতাধিক গাড়ির চাকাও প্রায় অচল। ফলে এসবের সঙ্গে জড়িত পাঁচ সহস্রাধিক শ্রমিক, দোকান কর্মচারীর অলস সময় পার করলেও মালিক পক্ষকে তাদের বেতন, ভাতা গুনতে হচ্ছে।
নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের দায়িত্বতে থাকা মং ত্রিপুরা জানান, বর্তমানে স্থানীয় মানুষ ছাড়া কেউ আসে না। অথচ আমাদের নিয়মিত ব্যয় হচ্ছে।আমরা পুরোপুরি হতাশ।
বান্দরবান আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন বান্দরবানে পর্যটন খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা।
সুন্দরবনে মহামন্দা
খুলনায় বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে। একের পর এক বাতিল হচ্ছে পর্যটকদের ভ্রমণ বুকিং। পর্যটন মৌসুমে এমন পরিস্থিতিতে চরম হতাশায় ব্যবসায়ীরা।
ট্যুর অপারেটর, পর্যটন ব্যবসায়ীদের লঞ্চ বা জাহাজের শ্রমিক রয়েছে ৩ হাজারেরও বেশি। ট্রিপ না থাকায় ভরা মৌসুমেই অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছেন তারা। এছাড়া লঞ্চ, জাহাজ না চললে শ্রমিকেরা খোরাকি পায় না। শুধু কোন রকমে বেতন নিয়ে চলতে হচ্ছে।
খুলনা থেকে সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যের মধ্যে সুন্দরবন ঘুরে আসার জনপ্রিয় স্থান সুন্দরবনের করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে প্রতিবছর লাখেরও বেশি পর্যটক ভ্রমণ করে। এখন সেখানে পর্যটক শূন্য।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) সাধারণ সম্পাদক এম নাজমুল আজম ডেভিড জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতায় পর্যটকরা যেমন অনিশ্চয়তায় রয়েছে, ঠিক তেমনি আমরাও অনিশ্চয়তায় রয়েছি। মানুষরা অগ্রিম টাকা দিয়ে বুকিং দিয়ে সেই টাকা ফেরত নিচ্ছে। আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
কক্সবাজারে পড়েছে ভাটা
কক্সবাজারের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউস ও কটেজগুলোতে বিশেষ ছাড় চললেও আশানুরূপ বুকিং নেই। ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন বার্মিজ মার্কেট, শুটকি মার্কেট, শামুক ও ঝিনুক মার্কেটসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, আগামী বছরের ঈদুল ফিতরের পরদিন থেকে কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকের ঢল নামবে।
কক্সবাজারের তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু বলেন, হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। কিছু কর্পোরেট বুকিং ছিল তারাও পরিস্থিতিতে আসতে চাচ্ছেন না।
তিন তারকা মানের আরেক হোটেলের ম্যানেজার ফারহান আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের নতুন করে কোন বুকিং হচ্ছে না। ডিসেম্বরে স্বাভাবিক সময় ৮০% অগ্রিম বুকিং হতো। ৫০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার পরও পর্যটক পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে মাত্র ১০ শতাংশ রুম ভাড়া দেওয়া যাচ্ছে।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস ও রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, হোটেল-মোটেল থেকে শুরু করে সৈকতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে আড়াই লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। কক্সবাজারের পর্যটনের সব খাতে প্রতিদিনই ১০০ কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে। হরতাল ও অবরোধ এভাবে চলতে থাকলে আমরা ব্যবসায়ীরা একদম শেষ হয়ে যাব।পর্যটনকে রাখতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত
পর্যটনকে হরতাল অবরোধের বাইরে রাখার দাবি জানিয়েছে পর্যটন শিল্পের সংশ্লিষ্টরা। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসার পথে গণপরিবহণ না পাওয়া ও রাস্তাঘাটে সংঘাত, সংঘর্ষের কথা চিন্তা করে ভ্রমণপিপাসুরা আসছেন না।
বেসরকারি পর্যটন নির্দেশনাকারী প্রতিষ্ঠান ‘জার্নি প্লাস’-এর স্বত্বাধিকারী ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তৌফিক রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো এই সময়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকে মুখরিত থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য বিদেশি পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বিদেশি পর্যটক তাদের অবসর কাটাতে বাংলাদেশে আসছেন না। বিদেশি পর্যটকরা বুকিং করেও তা বাতিল করছেন। আর যদি দেশের পর্যটকদের কথা বলি তাহলে এই ভরা মৌসুমে জমজমাট থাকে। কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিরতার কারণে এই সময়ে ৪৫ শতাংশ পর্যটক কমে গেছে। দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর হোটেলগুলোতে এই মুহুর্তে শতভাগ বুকিং হওয়ার কথা থাকলেও তা ৪০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। দেশের পর্যটন শিল্পকে লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
‘দ্য বেঙ্গল টুরিস্ট লিমিটেড’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মাসুদ হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: দেশে বছরে এক কোটি মানুষ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পর্যটন কেন্দ্রগুলো যায়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভরা মৌসুমেও ৯০ শতাংশ হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউসের কক্ষ খালি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার বিদেশি পর্যটকরা বাংলাদেশে ভ্রমণের উদ্দেশে এসেছিলেন। হোলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, কোভিড-১৯, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে পর্যটন মৌসুমগুলোতে হাজার পাঁচেক বিদেশি পর্যটকরা আসতেন। কিন্তু চলতি মৌসুমে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠান মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০ বিদেশি পর্যটকের বুকিং করেছে। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে বিদেশি পর্যটকও বাংলাদেশ ভ্রমণ বাতিল করছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে তাদের নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অনুরোধ তারা যেন দেশের স্বার্থে পর্যটন খাতকে অবরোধের বাইরে রাখেন।
আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে এবারের পর্যটন মৌসুমে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হতে পারে বলে শঙ্কা ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব)।
সংগঠনটির সভাপতি মো. শিবলুল আজম কোরেশী বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা চলমান থাকলে পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে পারবেন না। আমাদের বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। পর্যটন খাত নিয়ে ভবিষ্যতে এরকম যেন না হয় তা সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে। ভ্রমণপিপাসু মানুষরাতো টাকা দিয়ে মৃত্যু কিনতে চাইবে না।
Leave a Reply