1. admin@kishorganjeralo.com : kishorganjeralo.com :
  2. admin@shadinota.net : shadinota net : shadinota net
ব্রেকিং নিউজ :

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে- অধ্যাপক ডা: এম আমজাদ হোসেন

  • আপডেট সময় : শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩
  • ১৩৬ বার পঠিত

অধ্যাপক ডা: এম আমজাদ হোসেন :

১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত ৯ মাস ধরেই ওরা চালিয়েছিল মানব ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। নারী-শিশুসহ প্রাণ গিয়েছিল ৩০ লাখ বাঙালির। চার লাখ নারী তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। গ্রামের পর গ্রাম, নগর, জনপদ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এত বেশিসংখ্যক মানুষ হত্যার ঘটনা দ্বিতীয়টি নেই। ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে এই দিনটিকে ‘বাঙালি গণহত্যা স্মরণ দিবস’ হিসেবে জাতীয়ভাবে পালন করা হবে। এই দিবসে জাতি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করে সেই পূর্বসূরিদের, যারা একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত নিষ্ঠুরতম গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই হামলায় পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায় পুরান ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও সংলগ্ন এলাকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানায় থাকা তৎকালীন ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স ও আশপাশের এলাকায়। কারফিউ জারি করা হয় সারা শহরে। জনবসতিতে দেয়া হয় আগুন। বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় বিদ্যুৎসংযোগ। প্রাণভয়ে ছুটে পালানো মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে মারা হয়। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে ওঠে লাশের শহর। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ হত্যার পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

২৩ বছরের শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাত্রের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি পূর্বপরিকল্পিত সামরিক শক্তিকে ঢাকায় নামিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে। সেই রাতে ঢাকায় কত মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর কামান ও বন্দুকের গুলিতে মারা যায় তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দর, ফার্মগেট, রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, হলগুলো, পুরান ঢাকা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ ঢাকার অলিগলি, ফুটপাতে থাকা নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। ফলে ওই রাতেই ঢাকা শহরে ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এর চেয়েও বেশিসংখ্যক মানুষ আহত হয়, যার বেশির ভাগই চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়। অনেকেই মারা যায়, কেউ কেউ পঙ্গুত্ববরণ করে। তবে নির্বিচারে মানুষ হত্যার এই অভিযান পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধের ৯ মাস বন্ধ করেনি। ঢাকাসহ অন্য শহরগুলো থেকে দলে দলে মানুষ প্রাণ নিয়ে গ্রামের দিকে যাওয়ার পথে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে, বুড়িগঙ্গায় নৌকাযোগে পার হতে গিয়ে অনেকেই নৃশংস হত্যার শিকার হয়, নদীর ওপারে আশ্রয় নিতে বা দিতে গিয়েও অনেকে হত্যার শিকার হয়। এই হত্যা অব্যাহত থাকে গ্রামেগঞ্জে, সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময়-যেখানেই নিরস্ত্র মানুষকে দলবেঁধে কোথাও যাওয়ার উদ্দেশে যেতে দেখেছে, সেখানেই নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় এ ধরনের অসংখ্য গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য গণহত্যা। সভ্যতার বিপরীতে এর অবস্থান। গণহত্যা বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত, যার কোনো ক্ষমা নেই। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়। ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। কম সময়ে এত বেশি মানুষ আর কোথাও হত্যা করা হয়নি। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এই গণহত্যা শুরু করে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল থেকে গণহত্যা শুরু হয় এবং তা চলে চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই গণহত্যা চালানো হয়েছিল।

গণহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে রবার্ট পাইন ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তার ‘ম্যাসাকার’ গ্রন্থে লিখেছেন, মূলত ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলরা আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকদের খতম করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফেব্রুয়ারি মাসের এক সেনা-বৈঠকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান- ‘ওদের ৩ মিলিয়ন খতম করে দাও। দেখবে বাদবাকিরা আমাদের হাত থেকেই খাবার নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে।’ সত্যি সত্যিই ৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ৩০ লাখ নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে বর্বররা নির্মমভাবে হত্যা করে। ধর্ষণের শিকার হয় এ দেশের ৪ লাখ নারী। তাদের হত্যা তালিকায় ছিল এ দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আর নারীরা শিকার হয়েছিল ধর্ষণ, গণধর্ষণ শেষে হত্যার যার সূচনা হয় ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং পিলখানায় ইপিআর সদস্য বাঙালি জোয়ানদের হত্যার মধ্য দিয়ে। রবার্ট পাইনের মতে, প্রথম সপ্তাহেই শুধু ঢাকাতেই ৩০ হাজার মানুষ হত্যার শিকার হয়। এরপর গণহত্যা চলতে থাকে শহর পেরিয়ে গ্রামে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এমন স্থান পাওয়া যাবে না, যেখানে পাকিস্তানিরা নারকীয় তাণ্ডব চালায়নি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সর্বত্র ভাসতে থাকে লাশ আর লাশ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত বাঙালির জীবনে দুঃস্বপ্নের কালরাত। বাংলার বুকে নেমে আসে অত্যাচার, উৎপীড়ন, পাশবিকতা, নৃশংসতা আর হিংস্রতার কালো থাবা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ণ সামরিক সম্ভার নিয়ে শুরু করল বাংলাদেশব্যাপী পৃথিবীর ইতিহাসের এক জঘন্যতম গণহত্যা-ধ্বংসলীলা। রাতের অন্ধকারে কাপুরুষের মতো বাংলাদেশের নিরস্ত্র-নিরপরাধ জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল চরম নৃশংসতায়। যুদ্ধের সব নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে তারা মেশিনগান, মর্টার আর ট্যাংক নিয়ে বর্বরতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করল। সেদিনের সেই কালো স্মৃতি স্মরণ করে ‘বাংলা নামে দেশ’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে, ‘অন্যান্য দিনের মতোই দিনমজুর সারাদিন তার হাড়ভাঙা খাটুনির পর ক্লান্ত দেহখানি এলিয়ে দিয়েছিল বিছানায়, দোকানি তার দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরেছে, গৃহবধূ ঘরকন্না সেরে কেবল বিছানায় শুয়েছে। শিশুরা গভীর ঘুমে মগ্ন, ছাত্ররা পড়াশুনা রেখে এইমাত্র বিছানায় গিয়েছে, চাষি তার নতুন ফসলের স্বপ্নে বিভোর। ঠিক সেই মুহূর্তে ইয়াহিয়ার নরপিশাচরা তাদের হিংস্র থাবার আঘাত হানলো বাংলার বুকে। শ্রমিক, দোকানি, গৃহবধূ, শিশু, ছাত্র, কৃষক, পুলিশ, ই.পি.আর সবার ওপরই নেমে এলো সেই কালরাত্রির নিষ্ঠুরতা। ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ কাউকে বাঁচাতে পারলো না। ঘুমন্ত গৃহবধূ, শ্রমিক, শিশু, ছাত্র, দোকানি, পুলিশ, ই.পি.আর বুলেটের আঘাতে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে গেলো। স্বাধীনতার রক্তসূর্য দেখার সৌভাগ্য আর হলো না। টিক্কা খানের ভয়াবহ রক্তস্নানের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়লো বাংলার সর্বত্র। বইয়ে দিলো রক্তবন্যা।’

এ যুগে বহু হত্যাকাণ্ড হয়েছে। যেগুলোকে বলা হয় বর্বর গণহত্যা। যেমন জালিয়ানওয়ালাবাগ, শার্পভিল, মাইলাই হত্যাকাণ্ড এবং অন্যায় ও অবৈধ যুদ্ধে ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে লাখ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা। যাদের সংখ্যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো দেশে চলেছে গণহত্যার পাশাপাশি সিলেক্টেড কিলিং। যেমন- গত শতকের ত্রিশের দশকে জার্মানি, ইতালি ও স্পেনে হয়েছে।

জার্মানিতে ইহুদি হত্যার পাশাপাশি চলেছে বুদ্ধিজীবী নির্যাতন এবং হত্যা। রোমা রোঁলাকে হিটলারের কারাগারে জীবন দিতে হয়। টমাসম্যানসহ অসংখ্য সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর বই পুড়িয়ে ফেলা হয়। ইতালিতে মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট দলের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য আগে বিখ্যাত সাহিত্যিকসহ আলবার্তো মোরাভিয়াকেও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল।

কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ড ও বর্বরতাকে ম্লান করেছে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বর্বর হত্যাকাণ্ড। একদিকে চলেছে গণহত্যা ও গণধর্ষণ, অন্যদিকে চলেছে তালিকাভুক্ত দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চিহ্নিত হয়ে আছে কালরাত হিসেবে।
প্রত্যেক গণহত্যার একটি রাজনীতি আছে। সে রাজনীতিকে রাজনীতি না বলে অপরাজনীতি বলা যায়, অজুহাত তৈরি করে গণহত্যার এবং গণহত্যা অস্বীকারের। বাংলাদেশে গণহত্যারও একটি রাজনীতি ছিল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা যে গণহত্যা ও নির্যাতন চালিয়েছিল, বিশ্বের ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। গণহত্যার মধ্যে অন্তর্গত বিভিন্ন মানুষকে অকারণে হত্যা। জাতিগত বিদ্বেষ, রাজনৈতিক বিশ্বাস বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে হত্যা। হানাদারদের কারণে মানুষকে বাস্তুত্যাগ করতে হয়েছে। আশ্রয়ের খোঁজে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পাওয়ার পরও মহামারি ও নানা কারণে মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এসবই গণহত্যার মধ্যে অন্তর্গত।

বিভিন্ন উপায়ে সে সময় মানুষ হত্যা করা হয়েছে। কখনও কখনও নির্দিষ্ট একটি জায়গায় মানুষ এনে হত্যা করা হতো; যেমন, রায়েরবাজার বা মিরপুরের জলাভূমিতে। এসব জায়গা আমাদের কাছে পরিচিত বধ্যভূমি হিসেবে। অনেক সময় কিছু মানুষকে হত্যা করে একই সঙ্গে মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। এসব কবর আমাদের কাছে গণকবর হিসেবে পরিচিত।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে যে নির্বিচার যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা শুরু হয়, তার অন্তর্ভুক্ত ছিল টার্গেট কিলিং, ধর্মভিত্তিক নিধন, জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক নির্মূল, বেছে বেছে প্রগতিশীল ব্যক্তি নিধন। ওই সময় ‘জোনোসাইডাল রেপ’, ‘এনফোর্সড মাইগ্রেশন’, পরিকল্পিত গুম ইত্যাদি অপরাধ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হয়েছে যুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্যের বাইরে সাধারণের ওপর পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত আক্রমণ- নিবির্চার হত্যা তথা যুদ্ধাপরাধ।

জেনেভা কনভেনশন ও জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যা বলতে সমষ্টির বিনাশ ও অভিপ্রায়কে বোঝায়। এ গণহত্যা বলতে বোঝায় এমন কর্মকাণ্ড, যার মাধ্যমে একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজুলেশন ২৬০(৩)-এর অধীনে গণহত্যাকে এমন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা বিশ্বময় প্রতিরোধে সব রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। সংজ্ঞা অনুযায়ী, গণহত্যা কেবল হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এক্ষেত্রে জাতিগত, গোষ্ঠীগত বা ধর্মগত নিধনের উদ্দেশ্যে যদি একজন লোককেও হত্যা করা হয়, সেটাও গণহত্যা। যদি কোনো জাতি, গোষ্ঠী বা বিশেষ ধর্মের মানুষের জন্ম রুদ্ধ করার প্রয়াস নেয়া হয় বা পরিকল্পিতভাবে বিশেষ জাতি ও গোষ্ঠীভুক্ত নারীর গর্ভে একটি ভিন্ন জাতির জন্ম দেয়ার চেষ্টা করা হয়, সেটাও গণহত্যা।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের ২৫ মার্চের রক্তাক্ত অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এর প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের রায়কে অস্বীকার করা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং বাঙালির স্বাধীনতার দাবিকে চিরতরে ধ্বংস করা।
এ গণহত্যার স্বরূপ ছিল ভয়াবহ; যে অভিযান তারা ঢাকা নগরীতে শুরু করেছিল তা তারা চালিয়ে যায় সারা দেশে এবং নয় মাস ধরে। বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে এ গণহত্যাকে বিংশ শতাব্দীর ভয়াবহতম গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির দাবি আজও জাতিসংঘ থেকে মেনে নেয়া হয়নি।

কেবল বাংলাদেশ নয়, ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির যৌক্তিকতা ক্রমেই বিশ্বের অনেক মহল থেকেই উঠে আসছে। এ স্বীকৃতির প্রথম কারণ বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান বাহিনী যে নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তা পশ্চিমা বিশ্বে নথিভুক্ত। এ স্বীকৃতি সেসব হতভাগ্য মানুষের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানানো, তাদের স্মৃতি তর্পণ।

এ গণহত্যার স্বরূপকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা, যাতে মানুষ ইতিহাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে জ্ঞাত হয় এবং এমন অপরাধের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা গড়ে ওঠে। মূলত গণহত্যাকে ঘৃণা করা এবং আর যেন এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ কখনও না ঘটে সে ব্যাপারে পরিবেশ তৈরি করাই এ স্বীকৃতির উদ্দেশ্য।

‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়। সে কারণে অনেক মানুষকে হত্যা করা হলেই তা ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃত হয় না। সেসব হত্যাকাণ্ডকেই কেবল ‘জেনোসাইড’ বলা হয় যা কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বা ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা হয়েছিল।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানিও তা-ই করেছে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তারা পরিকল্পিতভাবে ১১ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছে।

বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যার স্মরণও একই কারণে। মানবতার বিরুদ্ধে যারাই নিকৃষ্টতম অপরাধ করে তাদের ঘৃণা করতে হবে, আর যেন এমন ভয়ঙ্কর অপরাধ অন্য কোথাও না ঘটে সে ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। জাতিসংঘকে তাই বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশের মাটিতে ৩০ লাখ মানুষের হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস বিস্মৃত হতে পারে না।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা গবেষণা করেন এবং পড়াশোনো করেন, তাদের কাছে মেজর সিদ্দিক সালিকের নাম বিশেষভাবে পরিচিত। এই পাকিস্তানি মেজরকে ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বদলি করা হয়। ঢাকা সেনানিবাসে তিনি তখন থেকে কর্মরত। সব মানুষ যেমন সমান হয় না, তেমনি পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম কেউ কেউ থাকতে পারেন। অন্তত সিদ্দিক সালিকের ব্যাপারে তা বলা যায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে তার অভিজ্ঞতার আলোকে একটি বই লিখেছিলেন। ইংরেজি ভাষায় লেখা তার বইটির নাম ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ তার বইটি পড়লে বোঝা যায়, একেবারে যে মোহমুক্ত হতে পেরেছেন তেমন নয়, তবে অনেকটা নির্মোহ চোখে দেখা সত্যকে তিনি প্রকাশ করেছেন। সিদ্দিক সালিকের ভাষ্যে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার প্রস্তুতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাঙালিকে আরও আত্মমর্যাদাপূর্ণ জাতিতে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ চায় দিবসটি যেন আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে মযার্দা পায়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই রকম আরো কিছু জনপ্রিয় সংবাদ

© All rights reserved © 2022 shadinota.net
Design & Development By Hostitbd.Com