নির্বাচিত হওয়ার পর একাধিক গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা এবং কাজ নিয়েও মন্তব্য করেন তিনি।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, ‘নির্বাচনের সময় কোনো সংকট তৈরি হলে, সংকট ম্যানেজার হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে এগিয়ে আসতে হয়। যদি সেরকম পরিস্থিতি হয়, তখন রাষ্ট্রপতি সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারেন। কাজেই রাষ্ট্রপতির যে কোনো দায়িত্ব নেই সেটা ভুল, রাষ্ট্রপতি ঐক্যের প্রতীক। সেই প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব পালন করেন সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে।’নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন যেন না হয়, কোনোরকম হস্তক্ষেপ যেন না হয়, আর প্রশাসন যেন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে সেটা দেখেন রাষ্ট্রপতি। জনগণ যাদের পছন্দ করবে তাদেরই ভোট দেবে, আর ভোটে যারা জিতবে আমি তাদের দলমত নির্বিশেষে কাজ করার আহ্বান জানাব।’
আগামী নির্বাচনে দেশের সব দল অংশ নেবে বলেও আশা প্রকাশ করেন মো.সাহাবুদ্দিন।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কতটুকু
সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান, কিন্তু তিনি সরকারপ্রধান নন। তার শুধু দুটি স্বাধীন ক্ষমতা রয়েছে।সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে পারেন। প্রধান বিচারপতি কে হবেন, তা নির্ধারণ করা এবং তাকে নিয়োগ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির। এছাড়া রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারেন। নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায় সে দলের নেতাকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। তবে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে, তখন দলের জোট থেকে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ করেন।
সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ৫ নম্বর পরিচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির পরোক্ষ ক্ষমতার কথা বলা আছে। এ ক্ষমতার বলে রাষ্ট্রপতির অনুরোধ মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী পেশ করেন। এছাড়া সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া বাকি সব দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেবেন।
পাশাপাশি কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের দেয়া দণ্ড মার্জনা বা ক্ষমা করার ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির।
সংবিধানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রনীতিসংক্রান্ত বিষয় রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করবেন প্রধানমন্ত্রী।
তবে রাষ্ট্রপতিকে দায়িত্ব পালন নিয়ে কোনো আদালতে জবাবদিহি করতে হবে না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা করা যাবে না। গ্রেফতার বা কারাগারে নেয়ার জন্য কোনো আদালত থেকে পরোয়ানাও জারি করা যাবে না।
এবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আলোচনায় ছিলেন যারা
আগামী বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিশ্বস্ত একজনকে রাষ্ট্রপতির পদে রাখতে চেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকজনের নাম আলোচনায় আসে। এরমধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকারী মসিউর রহমান। এছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চট্টগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের আলোচনায় বা গণমাধ্যমের কোনো সংবাদে সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর নাম কখনো আসেনি। হঠাৎ করেই তিনি রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন পান।
এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একজন অসাধারণ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আমাদের সংসদীয় দলের বৈঠক বসেছিল। তখন রাষ্ট্রপতি পদের মনোনয়নের জন্য সংসদীয় দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই ক্ষমতাবলে তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছেন।’
যেভাবে হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
দেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রণীত ১৯৯১ সালের আইন ও বিধিমালার আলোকে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়াদ পূর্ণ ও মৃত্যু কিংবা পদত্যাগ ও অপসারণের কারণে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। এর আগে প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হলেও ১৯৯১ সালের ২ জুলাই সংবিধানের ১২তম সংশোধনীতে পরোক্ষ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান করা হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ অনুসারে সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থীর সমর্থক ও প্রস্তাবক হতে হয় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে।তবে এবার সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি প্রার্থী দেবে না বলে আগেই জানিয়ে দেয়। আর সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় এবং কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বিনা ভোটে রাষ্ট্রপতি হন।
সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
সংবিধানের ১২তম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর শুধু ১৯৯১ সালেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা ভোট গ্রহণ করা হয়। ওই সময় সংসদে ক্ষমতাসীন বিএনপির সংসদ সদস্য ছিলেন ১৪০ জন। অন্য সংসদ সদস্যরা ছিলেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও অন্য সাতটি দলের। সে কারণে ভোটগ্রহণের প্রয়োজন হয়। এরপর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আর ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হয়নি।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ১৯৪৯ সালে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে পাবনা জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধেও তিনি অংশ নেন। ১৯৮২ সালে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে বিচার বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৯৫ সালে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন।
ছাত্রজীবনে তিনি পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ১৯৭৪ সালে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে সংঘটিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তিনি কারাবরণ করেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরপরই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়। ওই সময় হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ঘটনাও ঘটে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ওসব ঘটনার তদন্তে ‘কমিশন’ গঠন করেন, যার প্রধান ছিলেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। আওয়ামী লীগের সবশেষ জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে তিনি এক পুত্র সন্তানের পিতা এবং তার স্ত্রী প্রফেসর ড. রেবেকা সুলতানা সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব।
Leave a Reply