একজন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব৷ মন্ত্রীরা যাই বলুন না কেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের শাহীনবাগে যাওয়ার বিষয়টি সরকার আগে থেকেই জানতো৷ সেখানে যেন কোন ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সেটা আগে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল৷ সরকার বিষয়টি যেভাবে দেখভাল করেছে তা সঠিক হয়নি বলেই মনে করছেন কয়েকজন সাবেক কূটনীতিক৷ এতে বিভেদ বেড়েছে, গণতন্ত্রের কোন লাভ হয়নি৷
বাংলাদেশে ‘গুম’ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত ‘মায়ের ডাক’ নামের একটি সংগঠনের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলির শাহীনবাগের বাসায় গত ১৪ ডিসেম্বর গিয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস৷ সেখানে বাইরে অবস্থান করছিলেন ‘মায়ের কান্না’ নামের পৃথক একটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা৷ ‘মায়ের কান্না’ হলো ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিদ্রোহ দমনের নামে বিমানবাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য ‘গুমে’র ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সংগঠন৷ তুলির বাসায় ২৫ মিনিট অবস্থান করে বের হওয়ার পর অনেকটা ধস্তাধস্তির মধ্যে পড়েন মার্কিন দূত৷ এতে তিনি ক্ষুব্ধ হন৷ দ্রুত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন৷
মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে যে ঘটনাটি ঘটেছে তার ব্যাখা দিতে গিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত সাইফুল ইসলাম সবুজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একজন কূটনীতিক যে দেশে থাকেন সেখানে তিনি যে কোন কাজ করতে পারেন৷ আপনার তার কাজ পছন্দ না হলে আপনি তাকে বের করে দিতে পারেন৷ আইনে তাকে সেই সুরক্ষা দিয়েছে যে, সে দিনে দুপুরে খুন করলেও আপনি তাকে কিছু করতে পারবেন না৷ বিদেশি কূটনীতিকরা যে দেশে যান তার নিজের দেশের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও তার দেশের বৈদেশিক নীতি যেগুলো আছে সেটা দেখা তার দায়িত্ব৷ ট্রাম্প যাওয়ার পর বাইডেন প্রশাসনের কাছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে৷ এখানে তো বিদেশি কূটনীতিকরা নিয়মিত কথা বলেই যাচ্ছেন৷ এই কথা বলা তো ভিয়েনা কনভেশন পারমিট করে না৷ কোনটা বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য আর কোনটা গ্রহণযোগ্য না সেটা দেখার অধিকার কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের আছে৷ কেউ বেশি করে ফেললে সরকার তাকে বের করে দিতে পারে৷ কিন্তু এখানে তো তেমন কিছু হয়নি৷ মার্কিন রাষ্ট্রদূত তো মানবাধিকার দেখতে গেছেন৷ তার কাজ আপনার পছন্দ না হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে ডাকতে পারেন৷ মার্কিন রাষ্ট্রদূত যে ওইদিন সেখানে গেছেন সেটা তো সরকার জানত৷ তার সঙ্গে তো বাংলাদেশের সিকিউরিটি থাকে৷ সরকার তার যাওয়াটাকে পছন্দ করেনি৷ সরকারের উচিৎ ছিল, তার সঙ্গে কথা বলা৷ তার যাওয়াটাকে বাংলাদেশ সরকার যেভাবে হ্যান্ডেল করেছে সেটা আমার কাছে সঠিক মনে হয়নি৷’’
কেন আমাদের বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে যেতে হয়? জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘এর দু’টো কারণ আছে৷ এক. এটা আমাদের পুরনো রোগ৷ আমরা দীর্ঘদিন থেকেই এটাতে অভ্যস্ত৷ আমাদের এখানে নির্বাচন যখন হয়েছেও তখনও কিন্তু পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি৷ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে সবসময়ই দুর্বল ছিল৷ অনেক সময় মানুষ যখন প্রতিকার পায় না, তখন খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো তাদের কাছে যায়৷ যেহেতু গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের ব্যাপারে তারা সোচ্চার, কাজেই অনেকে মনে করেন তাদের কাছে বললে সুরাহা হতে পারে৷ আর দুই. যখন সরকারের কাছ থেকে প্রতিকার পাওয়া যায় না তখন অনেকেই তাদের কাছে যান৷ এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে৷ তবে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা একেবারেই কাঙ্খিত না৷’’
বধ্যভূমিতে না গিয়ে মার্কিন দূতের নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোনের বাসায় যাওয়ার সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের৷ ওই দিনই এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘‘আজ সকালে দেখলাম ২০১৩ সালে ‘গুম’ হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় গেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস৷ আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস৷ রাষ্ট্রদূত বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গেলে বেশি খুশি হতাম৷ আমরা কিন্তু সিএনএনে দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে কত মানুষ গুম হয়, কত নারী ধর্ষিত হয়, কত মানুষ খুন হয়৷’’
Leave a Reply