1. admin@kishorganjeralo.com : kishorganjeralo.com :
  2. admin@shadinota.net : shadinota net : shadinota net
ব্রেকিং নিউজ :

স্বাধীনতার ৫১ বছরেও সংরক্ষণ হয়নি ঈশ্বরদীর বধ্যভূমি

  • আপডেট সময় : শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ১২০ বার পঠিত

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য গণকবর ও বধ্যভূমি। তবে স্বাধীনতার ৫১ বছর কেটে গেলেও এ উপজেলার কোনো বধ্যভূমি এখনো সংরক্ষণ করা হয়নি। এমনক তৈরি হয়নি শহীদদের তালিকাও।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, উপজেলায় চিহ্নিত বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে প্রায় ৩০টি। এসব বধ্যভূমির বাইরেও উপজেলাজুড়ে অসংখ্য গণকবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শহীদদের এসব গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো এখন অযত্ম, অবহেলা আর দৃষ্টিসীমার বাইরে। ওইসব স্থান এখন ঘাস, ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ।

অনেক স্থান পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে। আবার কোথাও বসতবাড়িও নির্মাণ করা হয়েছে। স্বজন হারানো শহীদ পরিবারের সদস্যদের দাবি, বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক যাতে আগামী প্রজন্ম এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমী মানুষের আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারে।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল থেকে পাকসেনা ও তাদের দোসররা ঈশ্বরদীতে বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে। তাদের আগমনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে কিছু মানুষ নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেন। তারা ভেবেছিলেন পাকিস্তানি সৈন্যরা মুসলিম তাই মসজিদে অন্তত হামলা করবে না। কিন্তু পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধন করতে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদেও হানা দেয়।

পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালে কর্মরত আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. রফিক আহমেদকে তার তিন ছেলেসহ পরিবারের পাঁচজনকে নিমর্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল এ হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। সেদিন তাদের বাসায় বেড়াতে আসা এক আত্মীয়কেও নির্মমভাবে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। এই পাঁচ শহীদকে রাস্তার পাশে পানির ট্যাংকের কাছে সমাহিত করা হয় একটি গণকবরে।

পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। পাকশী পেপার মিল, অফিসার্স মেস ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পুলিশ ফাঁড়িতে ক্যাম্প করেছিল পাকবাহিনী। এসব ক্যাম্পে বন্দিদের হত্যা করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। পাকশী রেলস্টেশনে বাম দিকের জঙ্গলে বহু লাশ ফেলা হয়। পরবর্তীকালে এটিকে গণকবর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

১২ এপ্রিল অবাঙালিদের সহায়তায় লতিফ, আঁতু ও নান্নু তিন নামের সহোদরকে পাকশী রেল কলোনির ভেতরে হত্যা করে হানাদার হাহিনী। কয়েকদিন পড়ে থাকার পর সুইপাররা মরদেহ তিনটি কলোনির মধ্যেই গর্ত করে মাটিচাপা দেন।

 

ঈশ্বরদী রেল জংশন হলো উত্তরবঙ্গের সাথে দক্ষিণ বঙ্গের যোগাযোগের একমাত্র পথ। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ বাঙালিরা এ পথে ট্রেনযোগে যাতায়াত করতেন। ঈশ্বরদীতে তৎকালীন ২০ হাজার বিহারিদের বসতি ছিল। বিহারিরা ট্রেনে আগত যাত্রীদের ধরে জবাই ও গুলি করে হত্যা করতেন। রেলের ফাঁকা জায়গায় অসংখ্য বাঙালিদের হত্যার পর অবাঙালি ও রাজাকাররা মাটির নিচে চাপা দিয়ে রাখতেন।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঈশ্বরদী দখল করার দুদিন পর ১৩ এপ্রিল সকালে হামলা করে ঈশ্বরদীর কর্মকার পাড়ায় চন্দ্রকান্ত পালের পরিবারে। বিহারিরা চন্দ্রকান্ত পাল, তার দুই ছেলে, দুই পুত্রবধূ, ছয় নাতি-নাতনি ও একজন দোকান কর্মচারীসহ ১২ জনকে কুপিয়ে হত্যা করে। সবাইকে বাড়ির কূপের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়।

শহরের আলহাজ মিলের পেছনের কাশবনে পাকসেনা ও রাজাকাররা প্রায় দুই শতাধিক নর-নারীকে নিয়ে এসে হত্যা করে। এই বধ্যভূমি ও গণকবর আজও শনাক্ত করা হয়নি।

২৩ এপ্রিল পাকসেনারা বাঘইল পশ্চিমপাড়ার একটি বাড়িতে ২৩ জন নর-নারীকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে গ্রামবাসী মরদেহগুলো একটি বিশাল গর্ত করে পুঁতে ফেলে।

 

বিহারি-অধ্যুষিত ফতেহমোহাম্মদপুর লোকোশেডে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় ১২ ও ১৩ এপ্রিল অসংখ্য বাঙালিকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে বিহারিরা। এ হত্যাযজ্ঞে এখানে আজিজুল গনি, আব্দুল বারীসহ প্রায় ৩০-৩৫ জন শহীদ হন। ফতেহমোহাম্মদপুর রেলওয়ে কলোনি অর্থাৎ লোকোশেড পাম্প হাউজ স্টেশনে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। এখানে হত্যার জন্য গুলির পরিবর্তে ধারালো তরবারি বা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। রেলওয়ের এই পরিত্যক্ত পাম্প হাউজে কত বাঙালিকে যে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

লোকোশেডের উত্তর পাশে বর্তমান পানির ট্যাংকের পেছনে খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে ছোট বটগাছের নিচে রয়েছে একটি গণকবর। অথচ কোনো কবর বাঁধানো এমনকী নামফলক বা স্মৃতিচিহ্ন নেই যা দেখে মানুষ বুঝতে পারবেন এখানে মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী বাঙালিরা ঘুমিয়ে আছেন।

নুরমহল্লার খেলার মাঠের উত্তর কোণে রয়েছে একটি গণকবর। এই গণকবরে ১০-১২ জন শহীদ ঘুমিয়ে আছেন।

মাজদিয়া মাদরাসাপাড়ার একটি স্থানে অসংখ্য নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ এলাকাটি এখনো জামায়াত-অধ্যুষিত বলে এই গণকবরগুলো চিহ্নিত করা হয়নি।

 

ঈশ্বরদী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা চান্না মন্ডল জানান, ঈশ্বরদীতে মুক্তিযুদ্ধে ২৭ জন বীরমুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য বাঙালি শহীদ হন। তবে এখন পর্যন্ত শহীদদের কবর ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। গণকবরগুলো চিহিৃত করে সংরক্ষণ ও স্মৃতিফলক স্থাপনের দাবি জানান তিনি।

পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহীদ হওয়া মোয়াজ্জেম হোসেনের ছেলে বীরমুক্তিযোদ্ধা তহুরুল আলম মোল্লা জানান, ১৭ এপ্রিল মসজিদে ছিলেন তার বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন। পাকসেনা, রাজাকার ও বিহারিরা মসজিদের ভেতরে ঢুকে তাকেসহ বহু মুসল্লিকে ধরে এনে প্রেস ক্লাবের পাশে কয়লা ডিপোর কাছে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

বীরমুক্তিযোদ্ধা রেজাউল মোস্তফা বলেন, এ উপজেলার আরামবাড়িয়া গ্রামে আমার নিজ বাড়িতে পাকবাহিনী ও দোসররা হামলা চালিয়ে আমার মাসহ বেশ কয়েকজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এখন পর্যন্ত এ গণহত্যার স্থানে কোনো স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করা হয়নি।

ঈশ্বরদী মহিলা কলেজের সাবেক সহকারী অধ্যাপক স্বপন কুমার কুন্ডু বলেন, আমার বাড়ি অবাঙালি- অধ্যুষিত পৌর এলাকার ফতেমোহাম্মদপুরের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো পৌর এলাকা অবাঙাালিদের দখলে ছিল। কোনো বাঙালি শহরে আসতে পারতেন না। কেউ এলেই তাদের ধরে নিয়ে ফতেমোহাম্মদপুর পানির ট্যাংক ও রেললাইনের পাশে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে মরদেহ পুঁতে ফেলা হতো।

 

সমাজকর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব খোন্দকার মাহাবুবুল আলম দুদু বলেন, ঈশ্বরদী জংশন স্টেশন ও পার্শ্ববর্তী এলাকাজুড়ে পাকবাহিনী ও তার দোসরা নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। স্টেশনের পাশেই বসবাসরত অবাঙালিরা রেলে চলাচলকারী যাত্রীদের ধরে নিয়ে স্টেশনের মালগুদাম শেড ও রেললাইনের পাশে ঝোপঝাড়ে হত্যা করে গণকবর দিতো। এ গণকবরগুলো পরবর্তীতে চিহিৃত করা হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, লেখক ও বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদদের কবর চিহ্নিত ও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হলেও সেটিও এখন আর নেই।

তিনি বলেন, পাকবাহিনীর নৃশংসতা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করে যেখানে সেখানে মরদেহ ফেলে রাখতো। এসব মরদেহ সৎকার করারও লোক ছিল না। আত্মীয়-স্বজনরাও মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সাহস পাননি। চরম অবহেলায় সুইপাররা মরদেহগুলো গর্ত করে পুঁতে ফেলতেন।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে এসব বধ্যভূমি, গণকবর সংরক্ষণ ও নামফলক নির্মাণ অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করেন এই বীরমুক্তিযোদ্ধা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই রকম আরো কিছু জনপ্রিয় সংবাদ

© All rights reserved © 2022 shadinota.net
Design & Development By Hostitbd.Com