বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে আদিবাসী শব্দটি নানা সময়ে ক্ষমতাসীনদের কাছে তীব্র ‘অস্বস্তির’ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কখনও উপজাতি, কখনও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে তাদের পরিচয় নির্ধারণ করা হলেও আদিবাসী বলতে চায় না কেউ। যদিও পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি, আদিবাসী পরিচয় স্বীকৃতির। তাদের নেতারা বলছেন, আমাদের পরিচয় কীভাবে অন্যের দ্বারা নির্ধারিত হবে!
ঠিক কোন শব্দের মধ্য দিয়ে ‘তাদের’ সংজ্ঞায়িত করা হবে? বাংলাদেশে এই দ্বন্দ্ব কিংবা বিতর্ক বেশ পুরোনো। এই দফা আবারও বিতর্ক তৈরি হয় যখন পাঠ্যপুস্তকের গ্রাফিতিতে আদিবাসী থাকবে কি থাকবে না ইস্যুটি সামনে আসে। ২০২৫ সালের নতুন পাঠ্যপুস্তকে জুলাই অভ্যুত্থানের দেয়ালচিত্রগুলো সংযুক্ত করা হয়। সেখানে ‘গাছের পাতা ছেঁড়া নিষেধ’ শিরোনামে একটি গাছের চিত্রের বিভিন্ন পাতায় নানান ধর্মের নাম লেখা ছিল। যার একটিতে ‘আদিবাসী’ লেখা থাকায় আপত্তি তোলে এক সংগঠন। সেই আপত্তির ভিত্তিতে মাধ্যমিক পর্যায়ের এই পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত ছবিটি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদ জানায় নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। তাদের প্রশ্ন, জুলাই অভ্যুত্থানে কোনও বিভাজন ছিল না, এখন আদিবাসী পাতাটা গাছ থেকে ‘ছিঁড়ে ফেলা হবে’ কেন?
এরপর পাল্টাপাল্টি প্রতিবাদ সমাবেশ এবং সেখান থেকে নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ওপর ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ সংগঠনের কর্মীদের হামলায় প্রায় ২০ জন আহতের ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ জোরালো হয়ে ওঠে।
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে প্রেস উইং জানায়, বাংলাদেশে সহিংসতা, জাতিগত বিদ্বেষ ও ধর্মান্ধতার কোনও স্থান নেই। সরকারের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়, কেউ যদি সম্প্রীতি, শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
‘ছিঁড়ে ফেলা’ আদিবাসী পাতাসহ আসল ছবিটি ফেরত এনে তবেই বাকি আলাপ করা যেতে পারে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপত জোবাইদা নাসরিন বলেন, ‘গ্রেফতার ও বিচার একমাত্র দাবি নয়, এর সঙ্গে কেন ওই ছবি উইথড্র করা হলো সেই জবাব দিতে হবে এবং ছবিটি জায়গা মতো পুনঃস্থাপন করতে হবে। তার আগে দুঃখ-নিন্দা প্রকাশ করে সরকার দায়িত্ব এড়াতে পারবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যখন কোনও একটা সংগঠনের দাবিতে ছবিটি তুলে নেওয়া হলো তখন যেকোনও সংগঠন সেটাকে আশকারা হিসেবে দেখবে। এখানে আমি সরকারের দায়িত্বহীনতা বেশি দেখি।’
আদিবাসী বললে ক্ষতি কী? এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা অনেক কিছু সংস্কারের কথা ভাবতে পারলেও এটা নিয়ে অতটা সরব হতে পারছি না কেন প্রশ্নে জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘আমরা মনে করি বাংলাদেশ বহুজাতির দেশ। এখানে সবাই নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি, তবে ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তায় বিন্যস্ত। যেমন- বাংলাদেশি বাঙালি, বাংলাদেশি চাকমা, বাংলাদেশি মান্দি, বাংলাদেশি সান্তাল ইত্যাদি। এতো বিপুল বৈচিত্র্যকে এক শব্দে ধরা মুশকিল। আবার তখন বাঙালি বনাম আদিবাসী এমন এক অহেতুক বিভাজন তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এ কারণে আমরা মনে করি প্রত্যেকে বাংলাদেশি নাগরিক এবং তাদের স্ব স্ব জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে। পাশাপাশি সবার ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির অধিকারও অক্ষুণ্ন থাকতে হবে।’
অপসারণ করা গ্রাফিতি ফিরিয়ে আনতে হবে উল্লেখ করে আদিবাসী অধিকারকর্মী দীপায়ন খীসা বলেন, ‘কেবল দুঃখ প্রকাশ করে সরকার দায়িত্ব শেষ করতে পারে না। সেটা তখন বায়বীয় হয়ে যায়। আমরা অপরাধীদের গ্রেফতার দেখতে চাই। সেই সঙ্গে অপসারিত গ্রাফিতি পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারি নির্দেশনা দাবি করছি। আর আমার পরিচয় কী হবে না হবে সেটা একান্তই আমার বিষয়। অন্যরা আমার পরিচয় ঠিক করে দেওয়ার কে?’
উল্লেখ্য, এনসিটিবির সামনে আয়োজিত এক কর্মসূচিতে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুহম্মদ ইয়াকুব মজুমদার। দাবির মধ্যে রয়েছে- অবাঙালিদের (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী) আদিবাসী সম্বোধন করে কোনও বক্তব্য দেওয়া যাবে না, কোনও বইপুস্তক ছাপানো যাবে না, লেখালেখি করা যাবে না, কোনও নাটক-সিনেমা বা গল্পকাহিনি রচনা করা যাবে না। বাঙালিদেরই বাংলাদেশের একমাত্র আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের (অবাঙালি) ‘আদিবাসী’ বলা ও প্রচারণাকে রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
Leave a Reply