ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের আয়করমুক্ত সুবিধা পাওয়াকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলেও গ্রামীণ ব্যাংকের মতোই ব্র্যাক, আশা, টিএমএসএসসহ ৭ শতাধিক ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানকে কখনোই আয়কর দিতে হয়নি। শুধু তাই নয়, গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকও প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়করমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছিল। তবে, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রোষানলে পড়ে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় গ্রামীণ ব্যাংক। জানা গেছে, ওই সময় কর অব্যাহতি চেয়ে গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের কাছে আবেদন করলেও তাতে সম্মতি মেলেনি।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিষ্ঠানটির সব আয় করমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঋণ বিতরণ করা এই প্রতিষ্ঠানটি ২০২৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়করমুক্ত সুবিধা ভোগ করবে।আয়কর মুক্ত সুবিধা পায় ৭২১ প্রতিষ্ঠান
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার (এমআরএ) হিসাব মতে, দেশে নিবন্ধিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭২১টি। সবই বেসরকারি খাত বা ব্যক্তিপর্যায়ের প্রতিষ্ঠান। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির সনদ থাকা ঋণ বিতরণ করা এই ৭ শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে এনবিআরের কাছে আবেদন করতে হয় না। অর্থ আইনের ক্ষমতাবলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো আয়করমুক্ত সুবিধা ভোগ করে থাকে। চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির সনদ নেওয়া ঋণ বিতরণ করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭২১টি।
প্রতিবছরের মতো এবারও অর্থ আইনে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ অনুযায়ী, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিবন্ধিত কোনও সত্তার ক্ষুদ্রঋণ কর্মকাণ্ড হতে উদ্ভূত যেকোনও সার্ভিস চার্জ করমুক্ত রয়েছে।
যে কারণে গ্রামীণ ব্যাংককে আবেদন করতে হয়
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়কর দিতে হয় না। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির অধীনে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়কর অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়টি আইনে বলা আছে।
কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির সনদ পাওয়া ৭২১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নেই। এটি আলাদা আইনের দ্বারা পরিচালিত বলে সেই অব্যাহতির সুবিধা গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য হয় না। সেই কারণে মেয়াদ শেষে গ্রামীণ ব্যাংককে আবেদন করে মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে হয়। গ্রামীণ ব্যাংক মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির সনদ না নিলেও প্রতিষ্ঠানটি ব্র্যাক, আশা, টিএমএসএসের মতোই ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে থাকে। অথচ ২০২১ সালে এ প্রতিষ্ঠানটিকে অন্যায়ভাবে আয়করমুক্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গ্রামীণ ব্যাংক কর অব্যাহতি সুবিধা পেয়ে আসছিল। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ-১৯৮৩ বাতিল করে সরকার যখন ২০১৩ সালে আইন করে, তখনও বহাল রাখা হয় এ সুবিধা। কিন্তু ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি ওই সুবিধা বাদ দেয় তৎকালীন সরকার।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অন্য যারা কাজ করে তারা সবাই আয়করমুক্ত সুবিধা পায়। গ্রামীণ ব্যাংককে যেহেতু বাদ দেওয়া হয়েছিল, আমরা একই ফর্মুলায় সেটি এখন ঠিক করে দিলাম। তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক নামে ব্যাংক হলেও, আসলে তারা ক্ষুদ্রঋণ অপারেশনই করে থাকে। আমাদের আইনে মাইক্রোক্রেডিট অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যারা কাজ করে তাদের ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি আছে।
১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের আবেদনে এনবিআর তিন বছর পরপর প্রজ্ঞাপন জারি করে আয়কর অব্যাহতির মেয়াদ নবায়ন করে আসছিল।
উল্লেখ্য, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জামানত ছাড়াই গরিব মানুষকে টাকা ধার দেয়। সাধারণত দুই হাজার থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হয়, যেন ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তারা বিনিয়োগমুখী সম্পদ তৈরি করতে পারেন। যাদের জামানত দেওয়ার মতো সম্পদ নেই, আবার প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগও নেই, এমন জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়। স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেসরকারি উদ্যোগে এ দেশে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বড় বড় ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব মানুষকে ঋণ দিচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংক একটি আইন দ্বারা পরিচালিত পাবলিক অথরিটি। এর সূচনা ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের একটি গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে, যা গ্রামের গরিবদের ব্যাংকিং সেবা প্রদানের জন্য একটি ঋণ সরবরাহ ব্যবস্থা পরিকল্পনা করার জন্য পরিচালিত হয়। ড. ইউনূসের উদ্যোগে সরকারের অংশীদারত্বে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রামীণ ব্যাংক। ২০০৬ সালে এই কাজের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কারও জয় করেন। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ১ কোটি ৩ লাখ ৬০ হাজার জন। এর মধ্যে ৭১ লাখ ৬০ হাজার ঋণগ্রহীতা সদস্য ঋণ নিয়েছেন ২৪ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকটির সদস্যদের ঋণের স্থিতি ১৬ হাজার ১৫০ কোটি টাকা আর সঞ্চয় স্থিতি ২২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা।
২০১৫ সাল থেকে গড়িমসি শুরু
গ্রামীণ ব্যাংকের করমুক্ত সুবিধা বাড়াতে এনবিআরের গড়িমসি শুরু হয় ২০১৫ সাল থেকে। ওই বছর গ্রামীণ ব্যাংকের আবেদনটি দীর্ঘদিন এনবিআরে পড়েছিল কোনও সিদ্ধান্ত ছাড়াই। তখন গ্রামীণ ব্যাংক ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের জন্য আয়কর অব্যাহতি সুবিধা চেয়েছিল। ছয় মাসেও এনবিআর কিছু না জানানোয় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে চিঠিও দিয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংক।
গড়িমসি হলেও ২০১৬ সালের মে মাসে তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে গ্রামীণ ব্যাংকের আয়কর অব্যাহতি সুবিধা ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
কিন্তু সেই সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর গ্রামীণ ব্যাংকের আবেদনে আর সাড়া দেয়নি তৎকালীন সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস শুরু থেকে এই ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার সফল প্রয়োগের জন্য বাংলাদেশ পথিকৃৎ দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠান দেশে-বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন অবদানের জন্য ২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের চেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান, তখন তার সঙ্গে একই পুরস্কার জয় করেছিল গ্রামীণ ব্যাংকও।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে টানাপড়েন শেষে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসের মাথায় আবারও এই সুবিধা পেয়েছে ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র বিমোচন নিয়ে কাজ করা এই ব্যাংকটি।
২০২৯ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিকে কর অব্যাহতি দেওয়ার পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
ব্যাখ্যা দিলো এনবিআর
সোমবার (১৪ অক্টোবর) সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক ব্যাখ্যায় এনবিআর বলেছে, গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে ৩১ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখ পর্যন্ত, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান (নীতি) অনুবিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা ৮টি আদেশ বা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে, ওই প্রতিষ্ঠানের যেকোনও আয়ের ওপর আরোপণীয় আয়কর, সুপারট্যাক্স বা ব্যবসায়িক মুনাফা কর প্রদান হতে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।
এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক আইন, ২০১৩-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কোনও তফসিলি ব্যাংক নয় এবং প্রতিষ্ঠানটি মূলত ক্ষুদ্রঋণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। সমজাতীয় সেবা অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম করা সত্ত্বেও শুধু মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিবন্ধিত না হওয়ায় আয়কর আইন, ২০২৩ অনুসারে গ্রামীণ ব্যাংক একই প্রকার কর অব্যাহতির সুবিধা পাচ্ছিল না। অন্য সব ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের মতো গ্রামীণ ব্যাংকে অনুরূপ কর অব্যাহতি সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশের আওতায় ১ জানুয়ারি ২০১১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখ পর্যন্ত এবং ১ জানুয়ারি ২০১৬ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানকে কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়। সমজাতীয় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো গ্রামীণ ব্যাংক অনুরূপ কর অব্যাহতি সুবিধা না পাওয়ায় বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনে আয়কর আইনের আওতায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সরকারি গেজেটের মাধ্যমে ২০২৪ সালে ৯ অক্টোবর দ্বারা ৩১ ডিসেম্বর ২০২৯ তারিখ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের অর্জিত সব আয়কে শর্তসাপেক্ষে কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
এরআগে, ১০ অক্টোবর এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করার শর্তে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কাজ কিংবা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকিয়ে রাখতে সরকার বিভিন্ন সময় আইন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কর সুবিধা দিয়ে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংককেও শুরু থেকেই কর অব্যাহতি সুবিধা দিয়ে আসছিল সরকার।
এ প্রসঙ্গে এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, অনেকগুলো কারণে গ্রামীণ ব্যাংক আয়করমুক্ত সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে। তিনি বলেন, ঋণ বিতরণ করা এই প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য তৈরি হয়েছিল। ক্ষুদ্রঋণের পাশাপাশি শিক্ষাঋণ, গৃহঋণ দেওয়ার মতো কিছু সামাজিক কাজও করে গ্রামীণ ব্যাংক। তার মতে যেহেতু এই প্রতিষ্ঠান দরিদ্র ও নারীদের কল্যাণে কাজ করছে, সেহেতু এই প্রতিষ্ঠান আয়করমুক্ত সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে।
Leave a Reply