বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা যারা হয়েছেন, তারা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সশস্ত্র যোদ্ধা নন, নানান রকম সহযোগিতা করেছেন এমন লোকজন। যারা সশস্ত্র লড়াই করতে গেছেন এবং সেখানে মারা গেছেন তাদের আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করব।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম তিনি একই সঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন।ফারুক ই আজম একজন মুক্তিযোদ্ধা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, শহীদদের সংখ্যা, রাজাকারের তালিকাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন উপদেষ্টা।দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামোর সংস্কার, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি, ভূমিকম্পের প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন ফারুক ই আজম।
যেসব মুক্তিযোদ্ধার বয়স মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়ে ১২ বছরের কম ছিল, তাদের একবার বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সবাই একত্রিত হয়ে আদালতে রিট করেছিল। তিন হাজারেরও বেশি এমন রিট রয়েছে। সবগুলো রিট নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সেটিই প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় জানিয়েছেন।
আরেকটি পদক্ষেপ আমরা নিচ্ছি। একজন তরুণ, একজন কৃষক, একজন শ্রমিক কিংবা ছাত্র- তারা যুদ্ধক্ষেত্রে গেছে। আর একজন মানুষ যুদ্ধের সহায়ক হিসেবে গান গেয়েছেন, যুদ্ধের সময় আরেকজন মানুষ মুজিবনগরে চাকরি করেছেন, আরেকজন মানুষ যুদ্ধের পক্ষে বিদেশে গণসংযোগ করেছেন, বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অবদান আছে। সবার সবক্ষেত্রের অবদানগুলো স্বীকার করে আলাদা আলাদা করে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়।
যারা সশস্ত্র লড়াই করতে গেছেন এবং সেখানে মারা গেছেন তাদের আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করব।
জামুকা (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) যে সংজ্ঞার ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়েছে, সেখানে কেউ মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের বাতাস করেছে, সেও মুক্তিযোদ্ধা। যে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে সেও মুক্তিযোদ্ধা। দুজনের সমান মর্যাদা তো হতে পারে না। যারা সশস্ত্র লড়াই করেছে এটা তাদের মর্ম বেদনার একটা কারণ। বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা যারা হয়েছেন, তারা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সশস্ত্র যোদ্ধা নন, নানা রকম সহযোগিতা করেছেন এমন লোকজন। আমি বলছি, মুক্তিযোদ্ধা শব্দটিই বীরত্ব ব্যঞ্জক। মুক্তিযোদ্ধার আগে কেন আলাদা করে বীর শব্দটি লাগাতে হবে? যারা এই শব্দটি (বীর) যুক্ত করতে বলছে, তারা কি মুক্তিযোদ্ধা শব্দটিকে বীরত্ব ব্যঞ্জক মনে করেনি? কেন করব না? এটা তো অসঙ্গতি।
আমি তো সংস্কার করতে আসছি। যেহেতু বীর শব্দটি যুক্ত করতে বলছে তার মানে অ-বীর কেউ মুক্তিযোদ্ধা আছেন, ভীত কোনো মুক্তিযোদ্ধা আছে। এটা কেন করতে হবে? আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, এটা একটা গৌরবের ব্যাপার। সেখানে ত্যাগের বিষয়টি মহিমান্বিত হবে, সেখানে বীরত্বের বিষয়টি মহিমান্বিত হবে। সেখানে আরোপিত কোনো জিনিস দিয়ে তো হবে না।
বলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের কবর অন্য কবর থেকে আলাদা হবে। এ বিষয়ে একটি প্রকল্প আছে। এটি কি বৈষম্য নয়? এবার আন্দোলনের সময় থানা, উপজেলা পরিষদ পুড়িয়েছে। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অফিস পুড়িয়েছে। মানুষ যদি তাদের গণবিরোধী হিসেবে না চিহ্নিত করত তাহলে তো সেখানে কারো টাচ করার কথা নয়।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে আমরা কী নিতে পারি? স্যাক্রিফাইস (ত্যাগ) এবং হিরোইজম (বীরত্ব)- এ দুটোই তো আমরা ওখান থেকে শুধু নিতে পারি।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভোগের তাড়নায় লিপ্ত করেছে। ২০ হাজার টাকা করে ভাতা দিচ্ছি, এটা দিচ্ছি, সেটা দিচ্ছি। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারকে সাপোর্ট করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার গুলি করে মানুষ মারবে, ভোট না নিয়েই নির্বাচিত হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার যত ধরনের গণবিরোধী কাজই করবে, সবকিছুই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পর্দার আড়ালে থাকবে।
ত্যাগের মহিমাটা কি ক্ষুণ্ন করা হলো না? একটি অনির্বাচিত সরকার ১৫ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
আমরা সংস্কার করতে এসেছি।
যতটুকু সময় পাই… আমরা তো কেউ মন্ত্রী হতে আসিনি, দীর্ঘদিন থাকতেও আসিনি, এমন কোনো অভিলাষও নেই। আমি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) মিটিংয়ে গিয়েছিলাম, অনেক রকম প্রকল্প সেখানে দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের নামে বই প্রকাশ, বাচ্চাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানো- সত্যি সত্যি কি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানো হয়েছে?আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি ৫৩ বছর আগে। যুদ্ধের পরের ৫৩ বছর আমি কীভাবে যাপন করেছি। সেই জীবন নিরঙ্কুশ ছিল কি না? যদি না হয়, তবে সেই গল্প তরুণদের কাছে বলতে যাওয়া ঠাকুরমার ঝুলির গল্প বলার মতোই হয়ে যাবে।
আমি চোর ছিলাম, ডাকাত ছিলাম, আমার ব্যক্তিগত চরিত্র দুষ্ট, অসংযত জীবনযাপন করেছি- আমার সামাজিক পরিচিতি যদি এমন হয়, আর আমি যদি বাচ্চাদের সামনে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে চাই, সেটা কী হবে?
এরকমই ঘটনাগুলো ঘটেছে। এমন প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। গবেষণার কথা বলে লুটপাট হয়েছে।
শুনেছি অনেকে অর্ধেক কাজ করে পালাইছে, অনেকে চলে গেছে। আমি তাদের সবাইকে চিঠি দিতে বলেছি। তোমাদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যাও। সেগুলো চুক্তিভিত্তিক কাজ ছিল। টাকা নিয়ে গেছে, কিন্তু কাজ করে দিয়ে যায়নি। যারা এসব কাজে জড়িত ছিল তাদের সবাইকে সামনে উপস্থিত করতে চাই।
এগুলো হওয়া উচিত ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপর। স্বাধীনতার পরপর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, শহীদদের তালিকা, রাজাকার কারা ছিল তাদের তালিকা, দালাল কারা ছিল তাদের তালিকা, পাকিস্তানিদের সহযোগী কারা ছিল তাদের তালিকা, খুনিদের তালিকা, যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পর যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার এখনও তারা দাবি করে। তাই যদি দাবি করে থাকে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এসব বিষয় কেন তখন সম্পন্ন করে যায়নি?
বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা ৩০ লাখ। কিন্তু শহীদদের ভাতা দেওয়া হয় মাত্র কয়েক হাজার কেন? বাকিদের ভাতা দেওয়ার জন্য কেন আমরা পাচ্ছি না? শুনেছি এরা গণশহীদ। এরা গণশহীদ হোক সমস্যা নেই, যুদ্ধের কারণে আরও অনেক মানুষ মারা গেছে। তারা ওইভাবেই গণনার মধ্যে আসবে। ওই ভাবেই তাদের গণনা করা উচিত ছিল। এরা তো ওয়ার ক্যাজুয়ালটি (যুদ্ধের সহিংসতায় নিহত)। আপনি যখন কোনো সংখ্যা উল্লেখ করবেন, সংখ্যার পেছনে একটা পরিসংখ্যান থাকতে হবে। ওই সংখ্যাটা আপনি কোথায় পেলেন? আপনি পরিসংখ্যান ছাড়া কোনো সংখ্যা উল্লেখ করতে পারবেন না।
মুক্তিযুদ্ধটা অনেকের কাছে প্রহসনের মতো ছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত ছিল না, তারাই মুক্তিযুদ্ধকে অতিরঞ্জন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের যে মূল স্পিরিট ‘ত্যাগের মহিমা ও বীরত্বের গর্ব’ এসব বিষয়কে তারা নস্যাৎ করেছে।
কোনো তরুণ যদি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, প্রথমে তার সামনে ৩০ লাখের একটা মহাসাগর আসে। সে কোথা থেকে শুরু করবে, কোথায় গিয়ে শেষ করবে?
আমরা কি বংশ পরম্পরায় এই জিনিসগুলো বহন করে নিয়ে যাব? ৩০ লাখের ধারণা অনুযায়ী যদি গণশহীদ হয়, সেখানেও তো একটা গণনার বিষয় ছিল। অমুক বাড়িতে এতজন, অমুক বাড়িতে এতজন, এনিয়ে যুদ্ধে মোট এত মানুষ শহীদ হয়েছে। এদের আমরা শহীদ বলতে পারি। প্রত্যেকটি শহীদ হওয়ার একটা গল্প থাকে। কারণ শহীদ একটা গৌরবের ব্যাপার। একটি ন্যায় বিষয়ের জন্য একজন জীবন উৎসর্গ করেছে, সেই বিষয়টা গল্পহীন হতে পারে না। সেটা ধোঁয়াশা হতে পারে না।
আমরা কার ভয়ে করব না, আপনি আমাকে বলেন? এ জাতি কতদিন এ গ্লানি বহন করবে? যারা এটা দাবি করে তারা বলুক। এটা ৩০ লাখ নয়, তিন কোটি হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু যৌক্তিক হতে হবে। এসব বিষয় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবটা খর্ব করে দিয়েছে। আমি যুদ্ধ করেছি, একজন যোদ্ধা। এগুলোতে আমাদের মনে রক্তক্ষরণ হয়। প্রত্যেকটি যোদ্ধার একই অনুভূতি।
রাজনৈতিক কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকে অতিরঞ্জন হয়েছে। আমরা কি সেটা থেকে বেরিয়ে আসবো না? আমাদের সন্তানরা কি এই প্রহসনের মধ্যেই থেকে যাবে? তাদের এটা থেকে তো নিষ্কৃতি পেতে হবে।
যে কাজগুলো আমরা হাতে নিয়েছি, সেগুলো সম্পন্ন হোক। তারপর বাস্তবতার নিরিখে যদি মনে হয়, সেটা দেখা হবে। আমার ধারণা, আগামী ১০০ বছর যদি তালিকা করতে থাকি, তবে ১০০ বছর ধরেই মুক্তিযোদ্ধা হতে আবেদন আসতে থাকবে। কোনো না কোনো জায়গায় থেমে যাওয়া দরকার।
Leave a Reply